মহররম মাস ইসলামী বর্ষপঞ্জির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসের দশম দিন, অর্থাৎ আশুরা, ইসলামের ইতিহাসে বহুবিধ তাৎপর্যের প্রতীক। অনেকেই জানতে চান, “আশুরার রোজা কয়টি?” — বিশেষ করে ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে। এই প্রশ্নের উত্তর শুধু একটি সংখ্যার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এতে রয়েছে হাদিসের নির্দেশনা, রাসুল (সা.)-এর সুন্নত, আত্মশুদ্ধির শিক্ষা এবং ধর্মীয় পরিপূর্ণতা।
আশুরা নামের অর্থ কি
“আশুরা” শব্দটি আরবি ভাষার “আশারা” (عَشَرَة) মূল শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘দশ’। এই ‘দশ’ বলতে বোঝানো হয় হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের দশম দিনকে। ইসলামী পরিভাষায় এই দিনকে বিশেষভাবে “আশুরা” বলা হয়, যেটি আরবিতে “يوم عاشوراء” (ইয়াওমু আশুরা) নামে পরিচিত। শব্দগতভাবে “আশুরা” অর্থ দাঁড়ায়—“দশম” বা “দশম দিন”।
ইসলামের ইতিহাসে এই দিনটির রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য ও মর্যাদা। হাদিস ও ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, এই দিনে বহু গুরুত্বপূর্ণ নবীর জীবনে ঘটেছে অলৌকিক ও স্মরণীয় ঘটনা। যেমন: হজরত মূসা (আ.)-এর ফেরাউন থেকে মুক্তি, হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকার স্থির হওয়া, হজরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল হওয়া প্রভৃতি।
আশুরা নামটি কেবল একটি দিনের হিসেব নয়; বরং এর ভেতরে লুকিয়ে আছে আত্মত্যাগ, ধৈর্য, ইমান ও নৈতিকতার ইতিহাস। রাসুলুল্লাহ (সা.) এই দিনকে গুরুত্ব দিয়ে রোজা রাখতেন এবং উম্মাহকেও তা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। এদিন হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর কারবালার আত্মত্যাগও মুসলিমদের কাছে আশুরাকে একটি অনন্য ও হৃদয়বিদারক স্মৃতিতে পরিণত করেছে।
সুতরাং “আশুরা” নামটি যেমন ভাষাগত অর্থে একটি নির্দিষ্ট দিনের নাম, তেমনি তা ধর্মীয়ভাবে একটি আত্মশুদ্ধি, ত্যাগ ও আল্লাহর রহমত স্মরণের দিন হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত।
আশুরার রোজা কয়টি?
রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার দিনে রোজা রাখতেন এবং সাহাবীদের তা পালন করতে উৎসাহিত করতেন। তবে শুধু ১০ তারিখ নয়—তিনি বলেছেন ইহুদিদের অনুকরণ এড়াতে এটি ১ দিন আগে বা পরে মিলিয়ে ২ দিন রোজা রাখতে।
হাদিস ভিত্তিক রোজার সংখ্যা
👉 আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন:
“তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখো এবং তার সঙ্গে এক দিন আগে বা পরে মিলিয়ে রোজা রাখো।”
— Musnad Ahmad: 2154
👉 অন্য এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন:
“যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তবে নিশ্চয়ই ৯ ও ১০ মহররম রোজা রাখবো।” — Sahih Muslim: 1134
সঠিক করণীয়:
- ৯ ও ১০ মহররম (দুই দিন) রোজা রাখা সুন্নত
- কেউ চাইলে ১০ ও ১১ মহররম রোজাও রাখতে পারে
- সর্বোত্তম হচ্ছে ৯, ১০, ১১—এই তিন দিন রোজা রাখা
২০২৫ সালে আশুরার রোজার তারিখসমূহ
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী:
- ১ মহররম ১৪৪৭ হিজরি: ২৭ জুন ২০২৫ (শুক্রবার)
- ৯ মহররম: ৫ জুলাই ২০২৫ (শনিবার)
- ১০ মহররম (আশুরা): ৬ জুলাই ২০২৫ (রবিবার)
- ১১ মহররম: ৭ জুলাই ২০২৫ (সোমবার)
তাই ২০২৫ সালে আশুরার রোজা রাখতে চাইলে: ✅ অন্তত ৫ ও ৬ জুলাই (৯ ও ১০ মহররম)
✅ চাইলে ৭ জুলাই-ও (১১ মহররম) রোজা রাখা যেতে পারে
আশুরা সম্পর্কে হাদিস
আশুরা, অর্থাৎ মহররম মাসের দশম দিন, ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন এক দিবস। পবিত্র হাদিসে আশুরার দিনের ফজিলত, আমল এবং ইতিহাস নিয়ে অসংখ্য বর্ণনা পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে এই দিনে রোজা রাখতেন এবং উম্মতকে তা পালন করার উৎসাহ দিতেন।
১. এক বছরের গোনাহ মাফের ফজিলত
আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“আমি আল্লাহর উপর আশা রাখি যে, আশুরার রোজা বিগত এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেয়।”
— সহিহ মুসলিম: ১১৬২
এই হাদিস প্রমাণ করে যে আশুরার রোজা একটি মহা ফজিলতপূর্ণ ইবাদত, যা অতীত জীবনের ছোট ছোট গোনাহ মাফ করার উত্তম সুযোগ।
২. মূসা (আ.)-এর ঘটনার স্মৃতি
রাসুল (সা.) মদিনায় এসে দেখতে পান, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। কারণ, এদিনে আল্লাহ মূসা (আ.) ও তাঁর জাতিকে ফেরাউন থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তখন রাসুল (সা.) বলেন:
“আমরা মূসার (আ.) প্রতি তাদের চেয়ে বেশি হকদার।”
অতঃপর তিনি নিজে রোজা রাখেন এবং সাহাবীদেরও তা রাখার নির্দেশ দেন।
— সহিহ বুখারি: ২০০৪
৩. ইহুদিদের অনুসরণ না করা
রাসুল (সা.) বলেন:
“তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখো, তবে ইহুদিদের সাদৃশ্য যেন না হয়। তাই এর এক দিন আগে বা পরে রোজা রাখো।”
— মুসনাদ আহমাদ
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, ৯ ও ১০ বা ১০ ও ১১ মহররম একত্রে রোজা রাখাই সুন্নত এবং রাসুল (সা.)-এর প্রকৃত অনুসরণ।
৪. ইমাম হুসাইনের শাহাদাত ও আশুরার শিক্ষা
যদিও রাসুল (সা.)-এর সময়ে আশুরা রোজার দিন হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে পরবর্তীতে এই দিনটি আরও হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে কারবালার ঘটনার মাধ্যমে। হুসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ ইসলামের ন্যায়ের বার্তাকে চিরকাল উজ্জ্বল করে রেখেছে।
আশুরা সম্পর্কে এসব হাদিস আমাদের দেখায়, কেবল ঐতিহাসিকতা নয়—আশুরা হলো ইবাদত, তওবা, তাকওয়া এবং সত্যের পথে অটল থাকার এক অনন্য বার্তা। মুসলমানদের উচিত এই দিনটির মর্যাদা বোঝা এবং তা যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা।
আশুরার রোজার ফজিলত
রাসুল (সা.) বলেন:
“আশুরার রোজা পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়।”
— Sahih Muslim: 1162
এই হাদিস প্রমাণ করে যে আশুরার রোজা শুধুমাত্র ঐতিহাসিক স্মৃতির দিন নয়, বরং এটি গুনাহ মোচনের উপায়ও বটে।
এছাড়া এটি হজরত মূসা (আ.)-এর ফেরাউন থেকে মুক্তির স্মৃতিকে সম্মান জানানোর একটি ইবাদত, যা ইহুদিদের ভিন্নভাবে পালন করা মুসলিমদের জন্য আলাদা গুরুত্ব রাখে।
আরও পড়ুন-আশুরার রোজার ফজিলত ২০২৫
সাধারণ ভুল ধারণা
❌ অনেকে মনে করেন, আশুরা শুধু ১০ তারিখে রোজা রাখলেই হয়।
✅ প্রকৃতপক্ষে, এটি ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য না করার জন্য কমপক্ষে ২ দিন রোজা রাখার নির্দেশনা রয়েছে।
❌ কেউ কেউ মনে করেন, শুধু শোক পালনই আশুরার কাজ।
✅ এটি রোজা, দোয়া, আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর রহমতের দিন—শোকানুষ্ঠান ইসলামসম্মত নয়।
রোজা পালনের উপকারিতা
- পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহ মাফ হয়
- আত্মিক প্রশান্তি ও তাকওয়া বৃদ্ধি পায়
- রাসুল (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণ হয়
- হুসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ স্মরণে আত্মশুদ্ধির অনুপ্রেরণা
প্রশ্নোত্তর
❓ প্রশ্ন ১: আশুরার রোজা কয়টি রাখতে হয়?
✅ উত্তর: রাসুল (সা.) এর হাদিস অনুযায়ী আশুরার রোজা দুই দিন রাখা উত্তম—৯ ও ১০ মহররম, অথবা ১০ ও ১১ মহররম। কেউ চাইলে তিন দিন (৯, ১০, ১১) রোজাও রাখতে পারে, তবে কমপক্ষে দুই দিন রোজা রাখা সুন্নাত।
❓ প্রশ্ন ২: শুধু ১০ মহররম একদিন রোজা রাখা কি বৈধ?
✅ উত্তর: হ্যাঁ, শুধু ১০ তারিখ রোজা রাখা জায়েজ; তবে রাসুল (সা.) ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য এড়াতে আগের বা পরের দিন মিলিয়ে রোজা রাখতে বলেছেন। তাই একদিন নয়, দুই দিন রোজা রাখা সুন্নাত ও অধিক ফজিলতপূর্ণ।
❓ প্রশ্ন ৩: ২০২৫ সালে আশুরার রোজার তারিখ কী কী?
✅ উত্তর:
-
৯ মহররম: ৫ জুলাই ২০২৫ (শনিবার)
-
১০ মহররম (আশুরা): ৬ জুলাই ২০২৫ (রবিবার)
-
১১ মহররম: ৭ জুলাই ২০২৫ (সোমবার)
কমপক্ষে ৫ ও ৬ জুলাই রোজা রাখাই উত্তম।
❓ প্রশ্ন ৪: আশুরার রোজা রাখলে কী ফজিলত পাওয়া যায়?
✅ উত্তর: রাসুল (সা.) বলেন,
“আশুরার রোজা পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেয়।”
— সহিহ মুসলিম: ১১৬২
এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমত ও গুনাহ মোচনের এক সুবর্ণ সুযোগ।
❓ প্রশ্ন ৫: আশুরার রোজা কি ফরজ?
✅ উত্তর: না, আশুরার রোজা ফরজ নয়, এটি একটি সুন্নত ও highly recommended নফল রোজা। হাদিসে এ রোজার ফজিলত অত্যন্ত বেশি, তবে তা পালন না করলে গুনাহ হবে না, বরং একটি ফজিলত থেকে বঞ্চিত হওয়া যাবে।
❓ প্রশ্ন ৬: আশুরার রোজা কি শুধু শিয়া মুসলিমদের জন্য?
✅ উত্তর: না, এটি সমস্ত মুসলমানদের জন্য। রাসুল (সা.) নিজেই রোজা রাখতেন এবং সাহাবীদের তা রাখতে উৎসাহ দিতেন। কারবালার ঘটনা পরে ঘটেছে, কিন্তু আশুরার রোজার গুরুত্ব রাসুল (সা.)-এর সময় থেকেই আছে।
❓ প্রশ্ন ৭: আশুরার রোজা রাখার সময় কী কোনো বিশেষ নিয়ত পড়তে হয়?
✅ উত্তর: আশুরার রোজা রাখার জন্য কোনো নির্দিষ্ট নিয়ত নেই। মনে মনে ইচ্ছা ও নফল রোজার সাধারণ নিয়ত করলেই যথেষ্ট। আরবি বা বাংলায় নিয়ত পড়লেও সমস্যা নেই।
❓ প্রশ্ন ৮: মহিলা কি আশুরার রোজা রাখতে পারবে?
✅ উত্তর: অবশ্যই। পুরুষ-মহিলা উভয়ের জন্যই আশুরার রোজা রাখা মুস্তাহাব (সুন্নাত)। তবে যদি মহিলার মাসিক চলাকালীন হয়, তাহলে তিনি এই রোজা পরে কাযা করতে পারবেন না কারণ এটি ফরজ নয়।
❓ প্রশ্ন ৯: আশুরার রোজার নিয়ম ও করণীয় কী কী?
✅ উত্তর:
-
৯ ও ১০ বা ১০ ও ১১ মহররম রোজা রাখা
-
সাদকা ও নফল নামাজ পড়া
-
দোয়া ও ইস্তেগফার করা
-
কারবালার শিক্ষা স্মরণ করা
-
বিদআত, মাতম, শোকানুষ্ঠান পরিহার করা
উপসংহার
আশুরার রোজার সংখ্যা কোনো একক ফরমুলা নয়, বরং তা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস ও নির্দেশনার আলোকে পরিপূর্ণভাবে পালন করাই মুসলমানদের জন্য উত্তম। ২০২৫ সালে যথাযথভাবে ৯ ও ১০, অথবা ১০ ও ১১ মহররম রোজা পালন করে আমরা আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া ও গুনাহ মাফের পথে অগ্রসর হতে পারি।
আরও পড়ুন-মহরম ও আশুরা ২০২৫:কত তারিখে,আমল,রোজা,ফজিলত,ইতিহাস জানুন
👉🙏লেখার মধ্যে ভাষা জনিত কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
✅আজ এ পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন 🤔