আশুরার রোজার ফজিলত ২০২৫: রোজার দিন, হাদিস ও আমলসমূহ

ইসলাম ধর্মে কিছু নির্দিষ্ট দিন, সময় ও মাস রয়েছে যেগুলো আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে বরকতময় ও ফজিলতপূর্ণ করে রেখেছেন। তেমনি একটি দিন হলো আশুরা, অর্থাৎ মহররম মাসের ১০ তারিখ। প্রতি বছর এই দিনটি মুসলিম উম্মাহর জন্য নিয়ে আসে এক গভীর স্মরণ, শিক্ষা ও আত্মশুদ্ধির বার্তা।

২০২৫ সালে, বাংলাদেশের ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঘোষিত হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী, ১০ মহররম ১৪৪৭ হিজরি পড়েছে ৬ জুলাই ২০২৫, রোববার। ফলে আশুরার রোজা রাখার তারিখ হয় ৫ ও ৬ জুলাই অথবা ৬ ও ৭ জুলাই। এই সময় রোজা রাখলে একদিকে নবী করিম (সা.)-এর সুন্নত পালন হয়, অন্যদিকে এক বছরের ছোটখাটো গোনাহ মাফের ফজিলত পাওয়া যায়।

আশুরা নামের অর্থ কি

“আশুরা” শব্দটি এসেছে আরবি “আশারা” (عشرة) থেকে, যার অর্থ “দশ”। অর্থাৎ মহররম মাসের দশম দিনকে আশুরা বলা হয়। এই দিনটি শুধু ইসলামেই নয়, পূর্ববর্তী নবীদের যুগেও ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

আশুরার ঘটনাবলী

  • হজরত মূসা (আ.)-কে ফেরাউন থেকে মুক্তি দেন আল্লাহ – এই দিনে।

  • হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে স্থির হয় এই দিনে।

  • হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জন্ম হয় এই দিনে।

  • হজরত ঈসা (আ.) আকাশে তুলে নেওয়া হয় এই দিনে।

  • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা: কারবালার প্রান্তরে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত ঘটে এই দিনে।

আশুরা সম্পর্কে হাদিস

রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার রোজা রাখতেন এবং সাহাবিদেরও উৎসাহিত করতেন। তিনি বলেছেন:

“আশা করি, আল্লাহ তাআলা আশুরার রোজা বিগত এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন।”
— (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)

এটি শুধুমাত্র নফল রোজা নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধি ও ক্ষমা পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম। আশুরার রোজা হলো এমন একটি আমল যার মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারেন এবং পার্থিব জীবন থেকে আখিরাতের দিকে মনোনিবেশ করেন।

রাসুল (সা.) আরও বলেন:

“তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদীদের অনুকরণ না করে, আগের অথবা পরের দিনেও রোজা রাখো।”
— (মুসলিম: ১১৩৪)

আশুরার রোজার ফজিলত ২০২৫

আশুরার রোজা ইসলামী ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ আমল হিসেবে বিবেচিত। ২০২৫ সালে বাংলাদেশে আশুরা পালিত হবে ৬ জুলাই, রোববার, যা হিজরি ১৪৪৭ সালের ১০ মহররম। এই দিন রোজা রাখা সুন্নত এবং তা পালন করলে এক বছর পর্যন্ত গোনাহ মাফ হয়ে যেতে পারে—এমন সুসংবাদ দিয়েছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,

“আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা আশুরার রোজা দ্বারা বিগত এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন।”
(সহীহ মুসলিম: ১১৬২)

আশুরার রোজার এই ফজিলত মূলত সেই সময় থেকেই চলে আসছে যখন রাসুল (সা.) মদিনায় হিজরত করেন এবং দেখলেন ইহুদিরা এদিন রোজা রাখে। কারণ, এ দিনে হজরত মূসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের ফেরাউন থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন আল্লাহ। তখন রাসুল (সা.) বলেন,

“তারা যদি এ দিন রোজা রাখতে পারে, তবে আমরা তাদের চাইতে বেশি হকদার।”
এবং তিনি নিজেও রোজা রাখেন ও সাহাবীদের রোজা রাখতে বলেন।

২০২৫ সালে আশুরার রোজা শুধু অতীতের স্মরণ নয়, বরং এটি হয়ে উঠতে পারে বর্তমান জীবনে আত্মিক শুদ্ধি অর্জনের একটি চাবিকাঠি। এই রোজা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ত্যাগ, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য ও তাকওয়ার গুরুত্ব। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত এই দিনকে আরও গভীরভাবে ভাবায়, যদিও এ রোজা মূলত কারবালার ঘটনার কারণে নয়, বরং নবী মূসার (আ.) ঘটনার স্মৃতিতে রাখা হয়।

সুন্নত অনুসারে ৯ ও ১০ মহররম অথবা ১০ ও ১১ মহররম একত্রে রোজা রাখা উত্তম। তাই ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে রোজা রাখার উত্তম দিনগুলো হবে ৫–৬ জুলাই বা ৬–৭ জুলাই। এতে ইহুদি রীতির অনুকরণ এড়িয়ে রাসুল (সা.)-এর সুন্নতের পূর্ণতা অর্জিত হয়।

আরও পড়ুন-সিজদা থেকে উঠে কোন দোয়া পড়তে হয়?

এই রোজার মাধ্যমে শুধুমাত্র গোনাহ মাফ হয় না; বরং এতে রয়েছে বরকত, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আত্মশুদ্ধির এক অনন্য সুযোগ। এ রোজা এক বছরের পেছনের হিসাব নিজেকে নিজে দেওয়ার একটি উপলক্ষ, যেখানে মানুষ নিজের ভুল, গাফিলতি ও পাপ থেকে ফিরে আসার জন্য সুযোগ পায়। তাই এই দিনে তওবা করা, বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত, নফল নামাজ এবং সাদকা করাও অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ কাজ।

২০২৫ সালের আশুরা এমন এক সময়ে এসেছে যখন পুরো বিশ্ব নানা সংকটে জর্জরিত—নৈতিক অবক্ষয়, আত্মিক দুঃশ্চিন্তা এবং ইমানি দুর্বলতা আমাদের নিত্যসঙ্গী। এই প্রেক্ষাপটে আশুরার রোজা যেন হয়ে ওঠে আমাদের জীবনে নতুন এক আলোর দিশা, আত্মশুদ্ধি ও রাব্বুল আলামিনের রহমত লাভের সেতুবন্ধন।

আশুরার রোজা নিয়ত

আরবি:
نَوَيْتُ أَنْ أَصُوْمَ غَدًا لِعَاشُورَاء سُنَّةً لِلّٰهِ تَعَالَى

বাংলা উচ্চারণ:
“নাওয়াইতু আন আসূমা গাদান লিআশূরা সুন্নাতান লিল্লাহি তা’আলা।”

বাংলা অর্থ:
আমি আগামীকাল আশুরার রোজা রাখার নিয়ত করলাম, আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য।

আশুরার রোজা কবে ২০২৫

  • ৯ মহররম ১৪৪৭ হিজরি = ৫ জুলাই ২০২৫ (শনিবার)

  • ১০ মহররম (আশুরা) = ৬ জুলাই ২০২৫ (রোববার)

  • ১১ মহররম = ৭ জুলাই ২০২৫ (সোমবার)

👉 অর্থাৎ আপনি নিচের যেকোনো এক জোড়া দিনে রোজা রাখতে পারেন:

  • ৫ ও ৬ জুলাই (শনিবার ও রোববার)

  • অথবা ৬ ও ৭ জুলাই (রোববার ও সোমবার)

এই দুটি দিন রোজা রাখা ইহুদিদের একদিন রোজা রাখার অভ্যাস থেকে মুসলিমদের পৃথক করে এবং রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণের প্রতীক।

আশুরার দিনে করণীয় আমলসমূহ

আশুরা শুধু রোজা রাখার দিন নয়, বরং এটি একাধিক নফল ইবাদত, দোয়া ও সাদকার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ।

🧾 করণীয় কাজ:

  1. রোজা রাখা (সুন্নত রোজা)

  2. তওবা ও ইস্তিগফার (আত্মশুদ্ধির জন্য)

  3. নফল নামাজ – বিশেষ করে ২, ৪, ৮ রাকাআতের আলাদা আলাদা সালাত

  4. দোয়া ও কুরআন তেলাওয়াত

  5. পরিবার-পরিজনের জন্য অতিরিক্ত খরচ করা

    “আশুরার দিনে যে ব্যক্তি পরিবারে উদারতা করে, আল্লাহ তাআলা সারা বছর তার রিজিকে বরকত দেন।” – (বায়হাকি, শু‘আবুল ঈমান)

আশুরার ভুল ধারণা ও বর্জনীয় কাজ

অনেক মুসলমান ভুলভাবে আশুরাকে কেবলমাত্র শোকের দিন হিসেবে পালন করেন, অথচ রাসুল (সা.) কখনো মাতম, শোকসভা, রক্তপাত, নিজেকে আঘাত করা বা বেদনার চিহ্ন বহন করার অনুমতি দেননি।

❌ বর্জনীয় কাজ:

  • বুক চাপড়ানো বা শোকানুষ্ঠান করা

  • রাস্তায় মিছিল-মাতম

  • কোনো নির্দিষ্ট খাবারকে “আশুরার খাবার” বানিয়ে তা নিয়ে উদ্ভট আচরণ

  • মিথ্যা গল্প ও বিদআত ছড়ানো

📌 বিস্তারিত ফতোয়া: Islam QA – Innovations on Ashura

আশুরা আমাদের কী শিক্ষা দেয়?

আশুরা হলো সত্য ও ন্যায়ের পথে দৃঢ় থাকার প্রতীক। ইমাম হুসাইন (রা.) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন উৎসর্গ করে ইসলামের পতাকা রক্ষা করেছিলেন। এই দিনটি আমাদের শেখায়—

  1. ন্যায়ের পথে জীবন উৎসর্গ করার সাহস

  2. আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াস

  3. অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

  4. সুন্নাহর উপর অটল থাকা

প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্ন ১: আশুরার রোজা কেন রাখা উত্তম?
উত্তর: আশুরার রোজা রাখার মাধ্যমে বিগত এক বছরের ছোটখাটো গোনাহ মাফ হয় এবং এটি রাসুল (সা.)-এর সুন্নত। এটি আত্মশুদ্ধির অন্যতম মাধ্যম।

প্রশ্ন ২: ২০২৫ সালে আশুরার রোজা কখন পড়বে?
উত্তর: বাংলাদেশে ২০২৫ সালের ১০ মহররম (আশুরা) পড়বে ৬ জুলাই, রোববার। রোজা রাখার উত্তম সময় ৫-৬ জুলাই অথবা ৬-৭ জুলাই।

প্রশ্ন ৩: আশুরার রোজা রাখার নিয়ত কী?
উত্তর: নিয়ত রাতে বা ভোরে মনে মনে করতে হবে, উদাহরণস্বরূপ:
“নাওয়াইতু আন আসূমা গাদান লিআশূরা সুন্নাতান লিল্লাহি তা’আলা।” অর্থাৎ আমি আল্লাহর জন্য আগামীকাল আশুরার রোজা রাখার নিয়ত করলাম।

প্রশ্ন ৪: আশুরার রোজার সঙ্গে কি কোনো বিশেষ আমল যুক্ত?
উত্তর: হ্যাঁ, রোজার পাশাপাশি বেশি বেশি দোয়া, কুরআন তেলাওয়াত, নফল নামাজ এবং সাদকা দেওয়া উত্তম।

প্রশ্ন ৫: আশুরার রোজা কিভাবে ইহুদিদের রোজা থেকে আলাদা?
উত্তর: রাসুল (সা.) বলেছেন, ইহুদিরা শুধু ১০ মহররমের রোজা রাখে, কিন্তু আমরা ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ মহররম একত্রে রোজা রাখি।

📝 উপসংহার

আশুরার রোজা হলো মুসলমানদের জন্য এক অপূর্ব ইবাদতের সুযোগ। ২০২৫ সালে এই দিনটি যদি আমরা যথাযথ রকমে পালন করি, তবে ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজজীবনে বরকত আসতে বাধ্য। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে এই রোজা রাখার তাওফিক দেন এবং হজরত হুসাইন (রা.)-এর আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করার ক্ষমতা দেন—আমিন।

আরও পড়ুন-আরাফার রোযার নিয়ত ও ফজিলত

👉🙏লেখার মধ্যে ভাষা জনিত কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

✅আজ এ পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন 🤔

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহ। আমি মোঃ সানাউল বারী। পেশায় আমি একজন চাকরিজীবী এবং এই ওয়েবসাইটের এডমিন। চাকরির পাশাপাশি, আমি গত ১৪ বছর ধরে আমার নিজস্ব ওয়েবসাইটে লেখালেখি করছি এবং আমার নিজস্ব ইউটিউব এবং ফেসবুকে কন্টেন্ট তৈরি করছি। বিশেষ দ্রষ্টব্য - লেখায় যদি কোনও ভুল থাকে, তাহলে দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন। ধন্যবাদ।