রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমত, মাগফিরাত এবং নাজাতের মাস। এই মাসে প্রতিটি ইবাদতের সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়। তারাবির নামাজ রমজানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা রাতের বেলায় আদায় করা হয়। এটি নবীজি (সা.)-এর সুন্নত এবং সাহাবায়ে কেরামের আমলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। তবে তারাবির নামাজ কত রাকাত তা নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, তারাবির নামাজ ৮ রাকাতের দলিল কী? এই ব্লগ পোস্টে আমরা তারাবির নামাজ ৮ রাকাতের দলিল, এর পদ্ধতি, গুরুত্ব এবং এ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
তারাবির নামাজ কি?
তারাবির নামাজ হল রমজান মাসে রাতের সময় পড়া একটি বিশেষ নামাজ। এটি সুন্নতে মুয়াক্কাদা, অর্থাৎ নবীজি (সা.) নিয়মিত এটি আদায় করতেন এবং উম্মতকে এতে উৎসাহিত করেছেন। তারাবির নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা উত্তম, তবে একাকীও পড়া যায়।
তারাবির নামাজ ৮ রাকাতের দলিল
তারাবির নামাজ ৮ রাকাতের দলিল নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে আমরা হাদিস এবং সাহাবায়ে কেরামের আমলের দিকে নজর দেব।
১. হাদিসের আলোকে দলিল
- নবীজি (সা.) রমজান মাসে ৮ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও এতে উৎসাহিত করতেন।
- হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রমজান মাসে এবং অন্যান্য সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) ১১ রাকাতের বেশি নামাজ পড়তেন না। তিনি ৪ রাকাত পড়তেন, তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না। এরপর আরও ৪ রাকাত পড়তেন, তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো না। এরপর তিনি ৩ রাকাত বিতর পড়তেন।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১১৪৭)
- এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, নবীজি (সা.) ৮ রাকাত তারাবি এবং ৩ রাকাত বিতর আদায় করতেন।
২. সাহাবায়ে কেরামের আমল
- হযরত উমর (রা.)-এর সময়ে সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে নববীতে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করতেন। তবে এটি ছিল তাদের ইজতিহাদ (ব্যক্তিগত চেষ্টা) এবং নবীজি (সা.)-এর সরাসরি নির্দেশ নয়।
- হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “নবীজি (সা.) রমজান মাসে ২০ রাকাত তারাবি পড়তেন না।” (সুনানে বাইহাকী)
৩. ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মত
- হানাফি মাজহাব অনুযায়ী, তারাবির নামাজ ৮ রাকাত সুন্নত এবং বিতর ৩ রাকাত ওয়াজিব। এই মতের পক্ষে হাদিস এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল রয়েছে।
৪. অন্যান্য মাজহাবের মত
- শাফেয়ী, মালিকি এবং হাম্বলি মাজহাব অনুযায়ী, তারাবির নামাজ ২০ রাকাত। তবে তাদের দলিলগুলি মূলত সাহাবায়ে কেরামের আমলের উপর ভিত্তি করে।
তারাবির নামাজ ৮ রাকাত পড়ার নিয়ম
তারাবির নামাজ ৮ রাকাত আদায় করার পদ্ধতি খুবই সহজ। এটি প্রতি ২ রাকাত করে সালাম ফিরিয়ে আদায় করা হয়। নিচে ধাপে ধাপে পদ্ধতি দেওয়া হল:
১. নিয়ত করা
- প্রথমে তারাবির নামাজের নিয়ত করতে হবে। মনে মনে বলুন, “আমি ৮ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করব।”
২. প্রথম ২ রাকাত
- সুরা ফাতিহার পর অন্য একটি সুরা মেলান।
- রুকু, সিজদা এবং শেষে সালাম ফিরান।
৩. পরবর্তী ২ রাকাত
- একইভাবে আরও ২ রাকাত আদায় করুন।
৪. শেষ ২ রাকাত
- শেষ ২ রাকাত আদায় করে সালাম ফিরান।
৫. বিতর নামাজ
- তারাবির নামাজ শেষে ৩ রাকাত বিতর নামাজ আদায় করুন।
তারাবির নামাজের গুরুত্ব
তারাবির নামাজ রমজান মাসের একটি বিশেষ ইবাদত। এর মাধ্যমে মুমিন বান্দা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে এবং গুনাহ থেকে মুক্তি পায়। নবীজি (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজানের রাতে কিয়াম (তারাবি) আদায় করবে, তার আগের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৩৭)
নবী (সা.) কত রাকাত তারাবির নামাজ পড়তেন?
নবী (সাঃ) সাধারণত ৮ রাকাত তারাবির নামাজ পড়তেন। এটি সনদভিত্তিকভাবে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, নবী (সাঃ) কখনো কখনো ২০ রাকাতও পড়তেন, বিশেষ করে সাহাবাদের জন্য উত্সাহিত করতে।
হাদীস থেকে তথ্য:
- আবু হুরায়রা (রা.)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, নবী (সাঃ) রমজান মাসে ৮ রাকাত তারাবি নামাজ পড়তেন এবং তার পরে ৩ রাকাত উইত্র নামাজ পড়তেন (মুসলিম, বই 4, হাদীস 759)।
- তবে, ইমাম মালিক-এর মতে, পূর্ববর্তী কিছু সময়ে মসজিদে একসাথে ২০ রাকাত তারাবি পড়া হতো।
অতএব, নবী (সাঃ)-এর সময় ৮ রাকাত তারাবি নামাজ পড়া ছিল, তবে পরবর্তী সময় মুসলিম সম্প্রদায় ২০ রাকাত তারাবি নামাজ পড়তে শুরু করে।
১২টার পর তারাবির নামাজ পড়া যাবে কি?
রমজান মাসে তারাবির নামাজ মাগরিবের পর থেকে শুরু করে ফজরের আগ পর্যন্ত যে কোনো সময় পড়া যায়। তবে, রাতের শেষ ভাগে, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ নামাজের সময় তারাবি নামাজ পড়া অধিক সওয়াবের বলে বিবেচিত।
তবে, ১২টার পর (অর্থাৎ রাতের মধ্যভাগে) তারাবি নামাজ পড়া কোনো সমস্যা নেই। এটি একটি স্বাভাবিক সময়, বিশেষ করে যখন মানুষ রাতের তৃতীয় ভাগে বা শেষের দিকে অধিক সময় ধরে ইবাদত করতে চায়।
তারাবির নামাজ সুন্নত নাকি নফল
তারাবির নামাজ সুন্নত মোআক্কাদা (আবশ্যক সুন্নত) হিসেবে গণ্য। এটি রমযান মাসে লাইলাতুল কদরের জন্য আল্লাহর প্রতি বিশেষ নিবেদন এবং ইবাদত হিসেবে পড়া হয়। এর সাওয়াব অনেক বেশি, এবং সাওয়াবের উদ্দেশ্যে তা আদায় করা সুন্নত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।
এটি ফরজ নয়, কিন্তু মহানবী (সাঃ) নিজে তা পড়তেন এবং সাহাবারা (রা) এটা পালন করতেন।
প্রশ্ন-উত্তর
প্রশ্ন ১: তারাবির নামাজ কি জামাতের সাথে পড়া জরুরি?
উত্তর: তারাবির নামাজ জামাতের সাথে পড়া উত্তম, তবে একাকীও পড়া যায়।
প্রশ্ন ২: তারাবির নামাজ ২০ রাকাত পড়া যাবে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, পড়া যাবে। তবে ৮ রাকাত পড়াই সুন্নত।
প্রশ্ন ৩: তারাবির নামাজের সময় কখন?
উত্তর: ইশার নামাজের পর থেকে সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত তারাবির নামাজ পড়া যায়।
প্রশ্ন ৪: মহিলারা কি তারাবির নামাজ ঘরে পড়তে পারবেন?
উত্তর: হ্যাঁ, মহিলারা ঘরে তারাবির নামাজ আদায় করতে পারেন।
উপসংহার
তারাবির নামাজ রমজান মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি ৮ রাকাত আদায় করা সুন্নত এবং হাদিস ও সাহাবায়ে কেরামের আমলের মাধ্যমে এর দলিল প্রমাণিত। আমরা সকলেই যেন এই পবিত্র মাসে তারাবির নামাজ নিয়মিত আদায় করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারি, সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।
গুগল নিউজে SS IT BARI সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন
👉🙏লেখার মধ্যে ভাষা জনিত কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
✅আজ এ পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন 🤔