মানবসভ্যতার ইতিহাসে চিকিৎসা পদ্ধতির উৎপত্তি হাজার হাজার বছর আগে। প্রাচীন সভ্যতাগুলো তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো— পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন চিকিৎসা পদ্ধতি কোনটি?
এই ব্লগ পোস্টে আমরা প্রাচীনতম চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলোচনা করব, তাদের ইতিহাস, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এবং কিভাবে সেগুলো আজও প্রাসঙ্গিক।
পৃথিবীর প্রাচীনতম চিকিৎসা পদ্ধতি কোনটি?
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস গবেষণা করলে দেখা যায়, আয়ুর্বেদ পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি প্রায় ৫,০০০ বছরেরও বেশি পুরনো এবং ভারতীয় উপমহাদেশে এর উৎপত্তি। আয়ুর্বেদ শব্দের অর্থ “জীবনের বিজ্ঞান” (আয়ু = জীবন, বেদ = জ্ঞান)।
আরও পড়ুন
তবে, আয়ুর্বেদের চেয়েও প্রাচীন কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে, যেমন— প্রাচীন মিশরের চিকিৎসা (৩,০০০ খ্রিস্টপূর্ব) এবং প্রাচীন চীনের চিকিৎসা (২,৬০০ খ্রিস্টপূর্ব)।
আয়ুর্বেদ প্রাচীনতম চিকিৎসা পদ্ধতি
আয়ুর্বেদের প্রথম লিখিত রূপ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে (১,৫০০ খ্রিস্টপূর্ব)। পরবর্তীতে চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতা-এ বিস্তারিত চিকিৎসা পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে।
আয়ুর্বেদের মূলনীতি:
-
ত্রিদোষ তত্ত্ব (বাত, পিত্ত, কফ)
-
প্রাকৃতিক ভেষজ ও খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে রোগ নিরাময়
-
যোগ ও ধ্যানের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন
আয়ুর্বেদ আজও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রাচীন মিশরের চিকিৎসা পদ্ধতি
মিশরীয় সভ্যতা চিকিৎসাবিজ্ঞানে অগ্রগামী ছিল। এডউইন স্মিথ প্যাপিরাস (১,৬০০ খ্রিস্টপূর্ব) এবং এবার্স প্যাপিরাস (১,৫৫০ খ্রিস্টপূর্ব) মিশরীয় চিকিৎসার প্রমাণ বহন করে।
মিশরীয় চিকিৎসার বৈশিষ্ট্য:
-
জাদু ও ধর্মের সাথে চিকিৎসার সংমিশ্রণ
-
শল্য চিকিৎসার (সার্জারি) প্রাথমিক রূপ
-
মমিকরণ প্রক্রিয়ায় শারীরবিদ্যার জ্ঞান
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের তথ্য অনুযায়ী, মিশরীয়রা দাঁতের চিকিৎসা, হাড় জোড়া লাগানো এবং ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করত।
প্রাচীন চীনা চিকিৎসা: আকুপাংচার ও হার্বাল মেডিসিন
চীনা চিকিৎসা পদ্ধতি ২,৬০০ বছরেরও বেশি পুরনো। হুয়াংদি নেইচিং (Yellow Emperor’s Classic of Medicine) হলো চীনা চিকিৎসার প্রাচীনতম গ্রন্থ।
প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি:
-
আকুপাংচার (শরীরের নির্দিষ্ট পয়েন্টে সূচ ফুটিয়ে চিকিৎসা)
-
ইয়িন-ইয়াং তত্ত্ব (শরীরের ভারসাম্য রক্ষা)
-
হার্বাল মেডিসিন (জিনসنگ, গিংকো বিলোবা ইত্যাদি)
ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (NCBI) অনুসারে, আকুপাংচার ব্যথা কমানো ও রোগ প্রতিরোধে কার্যকর।
ইউনানি মেডিসিন গ্রিক ও ইসলামিক প্রভাব
ইউনানি মেডিসিন গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিসের তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত এবং পারস্য ও ভারতীয় চিকিৎসায় বিকশিত। এটি ২,৪০০ বছরের পুরনো।
ইউনানির মূলনীতি:
-
চারটি হিউমার তত্ত্ব (রক্ত, কফ, পিত্ত, কালো পিত্ত)
-
ভেষজ ও খনিজ পদার্থের ব্যবহার
-
আজও ভারত ও পাকিস্তানে প্রচলিত
আদিবাসী ও শামানিক চিকিৎসা
আদিবাসী সমাজে শামান (ঔষধমানুষ) রোগ নিরাময় করতেন প্রাকৃতিক উপাদান ও আধ্যাত্মিক পদ্ধতিতে। আমাজন, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে এই চিকিৎসা হাজার বছর ধরে চলে আসছে।
আধুনিক চিকিৎসায় প্রাচীন পদ্ধতির প্রভাব
প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো আজও আধুনিক মেডিসিনকে প্রভাবিত করে:
-
আয়ুর্বেদিক হার্বাল মেডিসিন (অশ্বগন্ধা, তুলসী)
-
চীনা হার্বাল ট্রিটমেন্ট (COVID-19 চিকিৎসায় গবেষণা)
-
হোমিওপ্যাথি ও ন্যাচারোপ্যাথি-এর ভিত্তি
পৃথিবীতে সর্বপ্রথম চিকিৎসা বিজ্ঞানী কে ছিলেন?
পৃথিবীতে সর্বপ্রথম চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসেবে সাধারণভাবে ইমহোটেপ (Imhotep)–কে বিবেচনা করা হয়।
উপসংহার
পৃথিবীর প্রাচীনতম চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে আয়ুর্বেদ, মিশরীয় ও চীনা মেডিসিন উল্লেখযোগ্য। এই পদ্ধতিগুলো আজও গবেষণা ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন জ্ঞান ও আধুনিক বিজ্ঞানের সমন্বয়েই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ।