যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি শুধু ধর্মীয় কর্তব্য নয়, বরং সামাজিক দায়বদ্ধতা ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদশালী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের একটি অংশ গরিব ও অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টন করে, যা সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে, এবং এটি শুধু নির্দিষ্ট কিছু সম্পদের উপরই প্রযোজ্য। অনেকেই জানেন না যে কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ হয়, কিংবা যাকাত প্রদানের সঠিক নিয়ম কী। এই ব্লগ পোস্টে আমরা যাকাত সম্পর্কিত সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, যাতে আপনি সঠিকভাবে যাকাত আদায় করতে পারেন এবং ইসলামের এই মহান ইবাদতের তাৎপর্য বুঝতে পারেন।
আমরা এখানে যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী, যাকাতযোগ্য সম্পদ, যাকাতের নিসাব, যাকাতের হকদার, এবং যাকাত সম্পর্কিত সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আশা করি, এই পোস্টটি আপনার জন্য উপকারী হবে এবং যাকাত সম্পর্কে আপনার জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি করবে।
যাকাত শব্দের অর্থ কি
যাকাত একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী, যাকাত হল সম্পদশালী মুসলমানদের জন্য ফরজ করা একটি আর্থিক ইবাদত। এটি গরিব ও অভাবগ্রস্তদের অধিকার, যা সম্পদশালীদের সম্পদে নির্ধারিত হারে প্রদান করতে হয়।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্তাবলী
যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। এগুলো হলো:
১. ইসলাম: যাকাত শুধু মুসলমানদের উপর ফরজ।
২. প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্ক: নাবালক ও পাগলের উপর যাকাত ফরজ নয়।
৩. নিসাব পরিমাণ সম্পদ: নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকা আবশ্যক।
৪. সম্পদের উপর এক বছর পূর্ণ হওয়া: সম্পদ নিসাব পরিমাণ হওয়ার পর এক বছর অতিক্রান্ত হতে হবে।
কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ?
যাকাত ফরজ হয় এমন সম্পদগুলোর তালিকা নিচে দেওয়া হলো:
১. নগদ অর্থ ও সোনা-রূপা
নগদ অর্থ, সোনা ও রূপার উপর যাকাত ফরজ। নিসাব পরিমাণ সোনা হল ৭.৫ তোলা (৮৭.৪৮ গ্রাম), এবং রূপা হল ৫২.৫ তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম)। যদি কারো কাছে এই পরিমাণ সোনা বা রূপা থাকে এবং এক বছর পূর্ণ হয়, তবে তার উপর যাকাত ফরজ।
২. বাণিজ্যিক পণ্য
যে সব পণ্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রয় করা হয়, তার উপরও যাকাত ফরজ। পণ্যের মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত দিতে হবে।
৩. কৃষি উৎপাদন
কৃষি উৎপাদনের উপর যাকাত ফরজ। এর জন্য নিসাব পরিমাণ হল ৫ ওয়াস্ক (৬৫৩ কেজি)। সেচের পদ্ধতি অনুযায়ী যাকাতের হার ভিন্ন হয়:
- প্রাকৃতিক বৃষ্টির পানিতে উৎপাদিত ফসলে যাকাতের হার ১০%।
- সেচের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলে যাকাতের হার ৫%।
৪. পশু সম্পদ
গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল ও উটের উপর যাকাত ফরজ। প্রতিটি প্রাণীর জন্য নিসাব পরিমাণ আলাদা। যেমন:
- উট: ৫টি উটের উপর ১টি বকরি।
- গরু: ৩০টি গরুর উপর ১টি এক বছর বয়সের বাছুর।
- ভেড়া বা ছাগল: ৪০টি ভেড়া বা ছাগলের উপর ১টি বকরি।
৫. খনিজ সম্পদ ও গুপ্তধন
খনিজ সম্পদ ও গুপ্তধনের উপরও যাকাত ফরজ। এর জন্য নিসাব পরিমাণ নির্ধারিত নেই, তবে এর ২০% যাকাত হিসেবে প্রদান করতে হবে।
৬. বিনিয়োগ ও শেয়ার
স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করা শেয়ার বা অন্যান্য বিনিয়োগের উপরও যাকাত ফরজ। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত দিতে হবে।
যাকাতের নিসাব কি
যাকাতের নিসাব হল সম্পদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ, যা অতিক্রম করলে যাকাত ফরজ হয়। নিসাব পরিমাণ সোনা, রূপা বা নগদ অর্থের বর্তমান বাজার মূল্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। বর্তমানে নিসাব পরিমাণ প্রায় ৯৬ গ্রাম সোনা বা এর সমমূল্যের সম্পদ।
যাকাতের হার
যাকাতের হার সাধারণত ২.৫%। তবে কৃষি উৎপাদন ও খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে এই হার ভিন্ন হতে পারে।
যাকাত দেওয়ার নিয়ম
যাকাত প্রদানের সময় কিছু নিয়ম মেনে চলা আবশ্যক:
১. যাকাতের টাকা শুধু যাকাতের হকদারদেরকেই দেওয়া যাবে।
২. যাকাতের টাকা পরিবারের সদস্যদের দেওয়া যাবে না।
৩. যাকাতের টাকা দান করার সময় নিয়ত করা জরুরি।
যাকাত প্রদানের খাত কয়টি
কুরআনে যাকাতের হকদার ৮ শ্রেণীর মানুষকে উল্লেখ করা হয়েছে:
১. ফকির: যার সম্পদ নেই।
২. মিসকিন: যার সম্পদ খুবই কম।
৩. যাকাত আদায়কারী: যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি।
৪. নওমুসলিম: ইসলাম গ্রহণকারী নতুন মুসলিম।
৫. দাস মুক্তির জন্য: দাসত্ব থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে।
৬. ঋণগ্রস্ত: যারা ঋণে জর্জরিত।
৭. আল্লাহর পথে জিহাদকারী: যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছে।
৮. মুসাফির: যাত্রাপথে অসহায় ব্যক্তি।
সর্বনিম্ন কত টাকা থাকলে যাকাত দিতে হবে
ইসলামিক শরীয়া অনুযায়ী, যাকাত ফরয হওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা আবশ্যক। নিসাব হল একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ, যা পূর্ণ এক বছর ধরে আপনার মালিকানায় থাকলে তার উপর যাকাত প্রদান করা বাধ্যতামূলক।
২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, নিসাবের পরিমাণ হল ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ বা ৫৯৫ গ্রাম রূপা এর মূল্যের সমতুল্য। বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী, এই পরিমাণ টাকার অঙ্কে নির্ধারণ করতে হবে।
আরও –তারাবির নামাজের দোয়া ও মোনাজাত বাংলায় উচ্চারণ সহ
উদাহরণস্বরূপ, যদি স্বর্ণের মূল্য প্রতি গ্রামে ৭,০০০ টাকা হয়, তাহলে নিসাবের পরিমাণ হবে:
৮৫ গ্রাম×৭,০০০ টাকা=৫,৯৫,০০০ টাকা
অর্থাৎ, আপনার কাছে যদি ন্যূনতম ৫,৯৫,০০০ টাকা বা তার বেশি পরিমাণ সম্পদ এক বছর ধরে জমা থাকে, তাহলে আপনাকে যাকাত দিতে হবে। যাকাতের হার হল সম্পদের ২.৫%।
মনে রাখবেন, এই হিসাব বাজার মূল্যের উপর নির্ভরশীল, তাই স্বর্ণ বা রূপার মূল্য পরিবর্তনের সাথে সাথে নিসাবের পরিমাণও পরিবর্তিত হতে পারে।
প্রশ্ন-উত্তর
প্রশ্ন ১: বাড়ি বা গাড়ির উপর যাকাত ফরজ হয় কি?
উত্তর: না, ব্যক্তিগত ব্যবহারের বাড়ি বা গাড়ির উপর যাকাত ফরজ হয় না। তবে যদি বাড়ি বা গাড়ি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, তবে তার উপর যাকাত ফরজ।
প্রশ্ন ২: ঋণের উপর যাকাত ফরজ হয় কি?
উত্তর: ঋণদাতা যদি ঋণ ফেরত পাওয়ার আশা রাখেন, তবে সেই ঋণের উপর যাকাত ফরজ।
প্রশ্ন ৩: যাকাতের টাকা দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করা যাবে কি?
উত্তর: না, যাকাতের টাকা শুধু যাকাতের হকদারদেরকেই দেওয়া যাবে। মসজিদ নির্মাণের জন্য অন্য সদকার টাকা ব্যবহার করা উচিত।
উপসংহার
যাকাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা সম্পদশালী মুসলমানদের উপর ফরজ। এটি শুধু ধর্মীয় কর্তব্য নয়, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষারও একটি মাধ্যম। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে আমরা গরিব ও অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করতে পারি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি।
গুগল নিউজে SS IT BARI সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন
👉🙏লেখার মধ্যে ভাষা জনিত কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
✅আজ এ পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন 🤔