ইতিহাসের জনক কে?

ইতিহাস শুধু অতীতের ধুলো-জমা পাতা নয়, এটি মানবসভ্যতার জীবন্ত দলিল। প্রাচীন সভ্যতার উত্থান-পতন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং সমাজের বিবর্তন বুঝতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় ইতিহাসের দিকে। কিন্তু এই ইতিহাসচর্চার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন কে? কে সেই মহান ব্যক্তিত্ব যিনি প্রথম পদ্ধতিগতভাবে ইতিহাস রেকর্ড করার ধারা শুরু করেছিলেন?

এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা এক নামেই পৌঁছাই – হেরোডোটাস। এই গ্রিক পণ্ডিতকে সারা বিশ্ব ‘ইতিহাসের জনক’ (Father of History) হিসেবে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। কিন্তু কেন তাঁকে এই উপাধি দেওয়া হয়েছে? কী ছিল তাঁর বিশেষত্ব? এই নিবন্ধে আমরা হেরোডোটাসের জীবন, তাঁর যুগান্তকারী রচনা ‘দ্য হিস্ট্রিজ’, এবং আধুনিক ইতিহাসচর্চায় তাঁর অবদান নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করব।

প্রাচীন গ্রিসের এই মহান ইতিহাসবিদ শুধু ঘটনার বিবরণীই লিপিবদ্ধ করেননি, তিনি প্রথমবারের মতো ইতিহাসকে একটি পদ্ধতিগত গবেষণার বিষয়ে পরিণত করেছিলেন। তাঁর লেখনীতে আমরা পাই না শুধু যুদ্ধ-বিগ্রহের বর্ণনা, বরং বিভিন্ন সভ্যতার সামাজিক কাঠামো, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ভৌগোলিক অবস্থানেরও বিস্তারিত বিবরণ।

ইতিহাসের এই মহান পথিকৃতের জীবন ও কাজ নিয়ে গভীরভাবে জানার আগে আসুন এক নজরে দেখে নিই কেন হেরোডোটাস এত গুরুত্বপূর্ণ।

হেরোডোটাস কেন গুরুত্বপূর্ণ?

  1. ইতিহাস রচনার পদ্ধতিগত সূচনা: তিনিই প্রথম ইতিহাসকে গল্পকথার স্তর থেকে উঠিয়ে একাডেমিক গবেষণার স্তরে নিয়ে যান।
  2. বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি: তিনি শুধু রাজা-মহারাজাদের কাহিনী নয়, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এবং ভৌগোলিক অবস্থানও বর্ণনা করেছেন।
  3. সূত্রের সমালোচনা: বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করার চেষ্টা করেন, যা আধুনিক ঐতিহাসিক পদ্ধতির ভিত্তি তৈরি করে।
  4. সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের সূচনা: বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন।

এই নিবন্ধের পরবর্তী অংশগুলোতে আমরা হেরোডোটাসের জীবন ও কর্ম নিয়ে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। জানাবো কিভাবে একজন গ্রিক পণ্ডিত সভ্যতার ইতিহাস রচনার ধারাই বদলে দিয়েছিলেন। সেই সাথে আমরা দেখব কেন কিছু সমালোচক তাঁকে ‘মিথ্যার জনক’ (Father of Lies) বলে সম্বোধন করেন, এবং এই অভিযোগগুলো কতটা যুক্তিসঙ্গত।

আরো-কে এই অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী?

ইতিহাসের এই মহান ব্যক্তিত্বকে বোঝার মাধ্যমে আমরা শুধু অতীতই নয়, বর্তমান ইতিহাসচর্চার ভিত্তিও বুঝতে পারব। তাহলে শুরু করা যাক

ইতিহাস কী?

ইতিহাস (History) হলো মানুষের অতীত ঘটনা, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়ন ও রেকর্ড। এটি কেবল তারিখ বা যুদ্ধের বিবরণ নয়, বরং মানুষের সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা, পরিবর্তনের ধারা এবং তার কারণ ও প্রভাব বিশ্লেষণের একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতি।

ইতিহাসের জনক

হেরোডোটাস (Herodotus) কে সাধারণত ইতিহাসের জনক (Father of History) বলা হয়। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে (৪৮৪-৪২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) গ্রিসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর রচিত “দ্য হিস্ট্রিজ” (The Histories) বইটিকে ইতিহাসের প্রথম পদ্ধতিগত রচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

হেরোডোটাসের জীবন ও কাজ

হেরোডোটাস এশিয়া মাইনর (বর্তমান তুরস্ক) এর হ্যালিকারনাসাস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গ্রিক-পারস্য যুদ্ধ (৪৯০-৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নিয়ে গবেষণা করেন এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ইতিহাস রচনা করেন।

হেরোডোটাস কেন ইতিহাসের জনক?

  1. প্রথম পদ্ধতিগত ইতিহাস রচনা – তিনি শুধু ঘটনাই লিপিবদ্ধ করেননি, বরং কারণ ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেছেন।
  2. নৃতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক বিবরণ – তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ, সংস্কৃতি ও ভূগোল নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।
  3. সূত্রের সমালোচনা – তিনি বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণ যাচাই করে ইতিহাস লিখেছেন, যদিও কিছু ক্ষেত্রে তাঁর বর্ণনায় কল্পনাও মিশে গেছে।

সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা

হেরোডোটাসকে কখনও কখনও “মিথ্যার জনক” (Father of Lies) বলা হয়, কারণ তাঁর কিছু বর্ণনা অতিরঞ্জিত বা অপ্রমাণিত। তবে আধুনিক ইতিহাসবিদরা মনে করেন, তিনি তাঁর সময়ের প্রেক্ষাপটে যথাসম্ভব সঠিক তথ্য দিয়েছেন।

অন্যান্য দাবিদার: থুসিডাইডিস

যদিও হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক বলা হয়, থুসিডাইডিস (Thucydides) কে বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের জনক বলা হয়। তিনি পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন এবং কারণ-প্রভাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতিহাসকে আরও যুক্তিনিষ্ঠ করে তোলেন।

হেরোডোটাস বনাম থুসিডাইডিস

বিষয় হেরোডোটাস থুসিডাইডিস
শৈলী বর্ণনামূলক, কাহিনীধর্মী বিশ্লেষণধর্মী, যুক্তিনির্ভর
সূত্র বিভিন্ন জনশ্রুতি ও পর্যবেক্ষণ সরাসরি সাক্ষ্য ও নথি
উদ্দেশ্য ঘটনা বর্ণনা যুদ্ধের কারণ ও কূটনীতি বিশ্লেষণ
ইতিহাসচর্চায় হেরোডোটাসের প্রভাব
  1. ইতিহাস রচনার পদ্ধতি – তিনি ইতিহাসকে গল্পের বাইরে নিয়ে গিয়ে গবেষণার বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
  2. সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সূচনা – তিনি শুধু যুদ্ধ নয়, মানুষের জীবনযাত্রা নিয়েও লিখেছেন।
  3. আধুনিক ইতিহাসবিদদের অনুপ্রেরণা – তাঁর কাজ পরবর্তীকালের ইতিহাসবিদদের জন্য মডেল হিসেবে কাজ করেছে।

আধুনিক ইতিহাসের জনক কে

আধুনিক ইতিহাসের জনক হিসেবে সাধারণভাবে স্বীকৃত হচ্ছেন লিওপোল্ড ফন রাংকে (Leopold von Ranke)। তিনি একজন জার্মান ইতিহাসবিদ ছিলেন এবং ১৯শ শতকে ইতিহাসচর্চায় বৈজ্ঞানিক ও সমালোচনামূলক পদ্ধতির প্রবর্তন করেন।

আধুনিক ইসলামের ইতিহাসের জনক কে

আধুনিক ইসলামের ইতিহাসের জনক হিসেবে সাধারণভাবে স্বীকৃত হচ্ছেন প্রফেসর মার্শাল হজসন (Marshall G. S. Hodgson) (১৯২২–১৯৬৮), একজন মার্কিন ইতিহাসবিদ ও ইসলামিক স্টাডিজ বিশেষজ্ঞ। তার মৌলিক গবেষণা ও পদ্ধতিগত অবদানের জন্য তাকে এই সম্মান দেওয়া হয়।

বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের জনক কে

বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের জনক হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত ব্যক্তিত্ব হলেন লিওপোল্ড ফন রাংকে (Leopold von Ranke, ১৭৯৫–১৮৮৬)। তিনি জার্মান ইতিহাসবিদ ছিলেন এবং ইতিহাসচর্চায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও সমালোচনামূলক গবেষণার ভিত্তি স্থাপন করেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসের জনক কে

বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে “ইতিহাসের জনক” হিসেবে কোনো একক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা যায় না, তবে কিছু ঐতিহাসিক ও গবেষক বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:

ড. নীহাররঞ্জন রায় (১৮৯৩–১৯৮১)

  • “বাঙ্গালীর ইতিহাস” (প্রথম প্রকাশ: ১৯৪৯) নামক গ্রন্থটি বাংলাদেশের (তৎকালীন বঙ্গ) প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস রচনায় মৌলিক অবদান রাখে।
  • তিনি শিল্প, সংস্কৃতি ও সমাজের ইতিহাসকে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন, যা পরবর্তী গবেষকদের জন্য প্রামাণ্য হয়ে উঠেছে।

সামাজিক ইতিহাসের জনক কে

সামাজিক ইতিহাসের (Social History) জনক হিসেবে সাধারণত দু’জন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদকে প্রধানভাবে বিবেচনা করা হয়:

মার্ক ব্লখ (Marc Bloch, ১৮৮৬–১৯৪৪)

ফরাসি ইতিহাসবিদ ও “অ্যানাল স্কুল”-এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি:

  • ইতিহাসে কেবল রাজা-রাজড়া বা যুদ্ধের বদলে সাধারণ মানুষের জীবন, কৃষি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণে জোর দেন।
  • তার বিখ্যাত গ্রন্থ “ফিউডাল সোসাইটি” (Feudal Society) মধ্যযুগের সামাজিক কাঠামো বুঝতে মৌলিক ভূমিকা রাখে।

প্রশ্নোত্তর

১. হেরোডোটাসকে কেন ইতিহাসের জনক বলা হয়?

হেরোডোটাসই প্রথম পদ্ধতিগতভাবে ইতিহাস রচনা করেন এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেন, তাই তাঁকে ইতিহাসের জনক বলা হয়।

২. হেরোডোটাসের বইয়ের নাম কী?

তাঁর বইয়ের নাম “দ্য হিস্ট্রিজ” (The Histories), যা গ্রিক-পারস্য যুদ্ধ ও বিভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে রচিত।

৩. হেরোডোটাসের বর্ণনা কি সবসময় সঠিক?

না, কিছু ক্ষেত্রে তাঁর বর্ণনা অতিরঞ্জিত বা অপ্রমাণিত। তবে তিনি তাঁর সময়ের প্রেক্ষাপটে যথাসাধ্য সঠিক তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

৪. থুসিডাইডিস কি হেরোডোটাসের চেয়ে ভালো ইতিহাসিক?

থুসিডাইডিস বেশি বিশ্লেষণধর্মী ও যুক্তিনির্ভর, তবে হেরোডোটাস ইতিহাসচর্চার ভিত্তি তৈরি করেছেন। দুজনেই গুরুত্বপূর্ণ।

৫. আধুনিক ইতিহাসবিদরা হেরোডোটাসকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

তাঁকে ইতিহাসের অগ্রদূত হিসেবে সম্মান করা হয়, যদিও তাঁর কিছু বর্ণনা নিয়ে বিতর্ক আছে।

উপসংহার

হেরোডোটাসকে ইতিহাসের জনক বলা হয় কারণ তিনিই প্রথম ইতিহাসকে একটি পদ্ধতিগত শাস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। যদিও তাঁর কিছু বর্ণনা বিতর্কিত, তবুও তাঁর অবদান ইতিহাসচর্চাকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। থুসিডাইডিসের মতো পরবর্তী ইতিহাসবিদরা তাঁর পথ ধরেই আরও উন্নত পদ্ধতিতে ইতিহাস রচনা করেছেন। ইতিহাস শুধু অতীতের ঘটনা নয়, এটি মানবসভ্যতার শিক্ষা ও ভবিষ্যতের পথনির্দেশক।

গুগল নিউজে SS IT BARI সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন

👉🙏লেখার মধ্যে ভাষা জনিত কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

✅আজ এ পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন 🤔

নোট:এই কনটেন্ট এর সকল ইনফরমেশন গুলো অনলাইন থেকে সংগৃহীত।

Assalamu Alaikum wa Rahmatullah. I am Md. Sanaul Bari. I am a salaried employee by profession and the admin of this website. Apart from my job, I have been writing on my own website for the past 14 years and creating content on my own YouTube and Facebook. Special Note - If there is any mistake in the writing, please forgive me. Thank you.