ইসলামের বরকতময় মাসগুলোর মধ্যে শাবান একটি বিশেষ মাস। এই মাসের ১৫ তারিখ, যাকে আমরা “শবে বরাত” বলে জানি, তা মুসলিম বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। অনেক ইসলামী শিক্ষামতে, এই রাতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাদের গুনাহ মাফ করেন, রিজিক নির্ধারণ করেন এবং ভাগ্য লিখেন। তাই মুসলমানগণ এই রাতকে ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করার চেষ্টা করে থাকেন।
আরও পড়ুন-শবে বরাতের রোজা নিয়ত বাংলায় এবং শবে বরাতের নামায
শাবান মাস ও ১৫ তারিখ: ইসলামী ব্যাখ্যা
শাবান মাস হিজরি বর্ষপঞ্জির অষ্টম মাস। ইসলামী পরিভাষায় ‘লাইলাতুল বরাত’ বলতে এই মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে বোঝানো হয়, অর্থাৎ ১৫ শাবানের রাত।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা ১৫ শাবানের রাতে পৃথিবীর দিকে বিশেষ রহমতের দৃষ্টিতে তাকান এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।”
— (ইবনে মাজাহ: ১৩৯০)
শবে বরাত নামটি কোথা থেকে এসেছে?
‘শবে বরাত’ শব্দটি ফার্সি, যার অর্থ হলো ‘মুক্তির রাত’। ‘শব’ অর্থ রাত এবং ‘বরাত’ অর্থ মুক্তি বা নিষ্কৃতি। মূলত এই রাতকে “মাগফিরাত” বা ক্ষমার রাত হিসেবেও বলা হয়। যদিও কুরআন ও সহিহ হাদিসে সরাসরি “শবে বরাত” শব্দটি নেই, তবে এর ফজিলত সম্পর্কে বহু হাদিস রয়েছে।
১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ যা করেন
ইসলামী কিতাবসমূহে বলা হয়েছে, এই রাতে আল্লাহ তাআলা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেন:
কাজের নাম | ব্যাখ্যা |
---|---|
গুনাহ মাফ | আল্লাহ এই রাতে বহু বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন। |
রিজিক নির্ধারণ | আগামী বছরের রিজিকের হিসাব নির্ধারিত হয়। |
মৃত্যুর তালিকা | যারা আগামী বছর মারা যাবে তাদের নাম লেখা হয়। |
ব্যবসা-বাণিজ্যের বরকত | অনেক ব্যবসায়ী এই রাতে ইবাদতের মাধ্যমে বরকত কামনা করে। |
১৫ শাবানের আমলসমূহ
শবে বরাতের রাতে যে সকল আমল করা উত্তম:
-
নফল নামাজ: বিশেষ করে ৬, ৮, ১০ বা ১২ রাকাত ইবাদত করার অভ্যাস অনেকেই করেন।
-
তওবা ও ইসতেগফার: অতীত জীবনের গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
-
কুরআন তিলাওয়াত: রাত জেগে কুরআন পাঠ করা একটি ফজিলতপূর্ণ কাজ।
-
জিকির ও দরুদ পাঠ: রাসূল (সাঃ)-এর উপর বেশি করে দরুদ পাঠ করা।
-
রোজা রাখা: অনেকে ১৫ শাবান উপলক্ষে রোজা রাখেন, যদিও এটি সুন্নত নয় তবে মুস্তাহাব।
শবে বরাত নিয়ে মতভেদ
উলামাদের মধ্যে শবে বরাত নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন এটি ফজিলতপূর্ণ রাত, আবার কেউ কেউ বলেন এর কোনো নির্দিষ্ট ইবাদত নেই। তবে বেশিরভাগ ইসলামী স্কলার ও হাদিস বিশারদগণ এই রাতের বিশেষ তাৎপর্যের কথা স্বীকার করেছেন।
বাংলাদেশে শবে বরাত উদযাপন
বাংলাদেশে শবে বরাতের রাতে:
-
মসজিদে বিশেষ ওয়াজ মাহফিল হয়
-
মুসল্লিরা মসজিদে রাতব্যাপী ইবাদত করেন
-
বাড়িতে হালুয়া-রুটি, জিলাপি ইত্যাদি খাবার তৈরি হয়
-
কবর জিয়ারত ও দোয়া করা হয়
তবে এই সব সংস্কৃতি ও প্রথা শরিয়তের আলোকে বিবেচনা করেই পালন করা উচিত।
আরও পড়ুন-আইয়ামে বীজের রোজা সম্পর্কে জানুন, এর নিয়ত, নিয়ম এবং ফজিলত
শবে বরাতের রাতে এই কাজগুলো থেকে বিরত থাকুন
-
আতশবাজি ও অশালীনতা
-
বিদআতপূর্ণ আমল
-
নির্দিষ্ট নামাজ বা রোজা মনে করে বাধ্যতামূলক মনে করা
-
অহেতুক ঘোরাঘুরি বা হৈচৈ
শাবান মাসের ফজিলত
ইসলামী বর্ষপঞ্জির অষ্টম মাস শাবান, যা ফজিলত ও রহমতের এক বিশেষ সময়। হাদিস অনুযায়ী, এই মাসে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) অধিক রোজা রাখতেন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও রহমত প্রার্থনায় মনোযোগী হতেন। শাবান মাসকে ‘আমলের প্রস্তুতির মাস’ বলা হয়, কারণ এই মাসের মধ্যরাতে (শবে বরাত) আল্লাহ বান্দার তাকদির নির্ধারণ করে থাকেন বলে অনেক মত রয়েছে। তাই শাবান মাসে বেশি বেশি ইবাদত, রোজা, কোরআন তিলাওয়াত এবং দান সদকা করা বিশেষ ফজিলতের কাজ।
ℹ️ এই ধরনের আরও কন্টেন্ট নিয়মিত পেতে ফেসবুক পেজে যুক্ত থাকুন।
শাবান মাসের দোয়া
শাবান মাসে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, বিশেষত শবে বরাতের রাতে। এই মাসে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) একটি বিশেষ দোয়া পাঠ করতেন:
“আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শা’বান, ওয়াবাল্লিগনা রামাদান।”
অর্থাৎ: “হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।”
এই দোয়া নিয়মিত পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত, বরকত ও হেদায়েত লাভ করা যায়। শাবান মাসে বেশি বেশি করে এই দোয়া ও ইস্তেগফার করা উত্তম আমল।
শাবান মাসের রোজা
❓ প্রশ্ন উত্তর
✅ শাবান মাসের ১৫ তারিখে কী বিশেষ ঘটনা ঘটে?
উত্তর: শাবান মাসের ১৫ তারিখে লাইলাতুল বরাত (Shab-e-Barat) উদযাপন করা হয়। এই রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য রহমত, মাগফিরাত ও নেকী বরাদ্দ করেন। ইসলামি বিশ্বাস মতে, এ রাতে ভাগ্যনামা লিখিত হয় এবং গুনাহগারদের ক্ষমা করা হয়, যদি তারা খালিস মনে তওবা করে।
✅ লাইলাতুল বরাত রাতে কী ইবাদত করা উত্তম?
উত্তর: এ রাতে নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া, জিকির ও তওবার মাধ্যমে ইবাদত করা উত্তম। হাদীস অনুযায়ী, এ রাত আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সুযোগ।
✅ এই রাতে কবর জিয়ারত করা কি সুন্নত?
উত্তর: হ্যাঁ, রাসূল (সা.) শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতে কবরস্থান পরিদর্শন করেছেন বলে সাহাবিদের বর্ণনায় পাওয়া যায়। তাই এ রাতে কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব আমল হিসেবে গণ্য হয়।
✅ শবেবরাত উপলক্ষে রোজা রাখা কি জরুরি?
উত্তর: শাবান মাসের ১৫ তারিখের পরদিন রোজা রাখা মুস্তাহাব (উত্তম)। রাসূল (সা.) শাবান মাসে অনেক রোজা রাখতেন। তবে একে বাধ্যতামূলক বা নির্দিষ্ট ফজিলতপূর্ণ রোজা মনে করা ঠিক নয়।
✅ শবেবরাতের রাতে হালুয়া রুটি, বাতি জ্বালানো কি ইসলামে আছে?
উত্তর: হালুয়া-রুটি তৈরি করা, বাতি জ্বালানো, আতশবাজি করা ইত্যাদি বিষয়গুলো ইসলামের নির্ভরযোগ্য উৎসে নেই। এগুলো লোকাচার বা সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চালু হয়েছে। ইসলাম শুধু ইবাদত, তওবা ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।
✅ শবেবরাতের রাতে আল্লাহ কাদের ক্ষমা করেন না?
উত্তর: হাদীস অনুযায়ী, এই রাতে আল্লাহ অনেক গুনাহগারকে ক্ষমা করেন, তবে মুশরিক (শিরককারী), হিংসুক, আত্মীয়ের সম্পর্ক ছিন্নকারী, গীবতকারী, অহংকারী ও অবিচারকারীদের ক্ষমা করা হয় না—যতক্ষণ না তারা তওবা করে।
✅ শবেবরাতের রাতে কোনো নির্দিষ্ট নামাজ বা সুরা আছে কি?
উত্তর: ইসলামের নির্ভরযোগ্য সূত্রে শবেবরাতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো নামাজ বা সুরা পড়ার নির্দেশনা নেই। তবে যে কোনো সুন্নত নামাজ, তাহাজ্জুদ, এবং দোয়া করা উত্তম।
✅ শবেবরাত সম্পর্কে হাদীসে কী বলা হয়েছে?
উত্তর: হাদীসে এসেছে, “আল্লাহ তাআলা শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে প্রথম আসমানে এসে বলেন, ‘আছে কি কেউ ক্ষমা প্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করবো।’” (ইবনে মাজাহ)। তবে এই হাদীসের গ্রেড নিয়ে মতভেদ আছে, তাই আলেমরা সতর্ক থেকে ইবাদত করতে বলেন।
উপসংহার
শাবান মাসের ১৫ তারিখ বা শবে বরাত মুসলমানদের জন্য একটি আত্মবিশ্লেষণের রাত। এটি এমন একটি সুযোগ, যেখানে মানুষ তার অতীতের ভুল থেকে ফিরে এসে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইতে পারে। ইসলামের আলোকে এই রাতের গুরুত্ব অনেক, তবে সব কিছুই করতে হবে শরিয়তের নির্ভুল নির্দেশনার আলোকে। ইবাদত হোক বিনয় ও আন্তরিকতায় ভরপুর।
আরও পড়ুন-শবে বরাত ২০২৫ কত তারিখে?
👉টেক নিউজের সকল খবর সবার আগে পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন!
👉🙏লেখার মধ্যে ভাষা জনিত কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
✅আজ এ পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন 🤔