বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়?

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি শুধু আর্থিক ইবাদতই নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদশালী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের একটি অংশ গরিব ও অসহায় মানুষের মধ্যে বণ্টন করে, যা সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে।

বর্তমানে অনেকেই জানতে চান, “বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়?” এই প্রশ্নের উত্তর জানা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকা আবশ্যক, যা ইসলামী শরীয়তে “নিসাব” নামে পরিচিত। নিসাবের পরিমাণ সময় ও বাজার মূল্যের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। তাই ২০২৫ সালের বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী নিসাবের পরিমাণ জানা এবং যাকাতের সঠিক হিসাব করা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব।

আরও –কোন কোন সম্পদের উপর যাকাত ফরজ?

এই ব্লগ পোস্টে আমরা যাকাত ফরজ হওয়ার নিসাব পরিমাণ, যাকাতের শর্তাবলি, যাকাতের হিসাব পদ্ধতি এবং যাকাতের গুরুত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। পাশাপাশি যাকাত সম্পর্কে সাধারণ কিছু প্রশ্ন ও উত্তরও তুলে ধরব, যা আপনার যাকাত সংক্রান্ত সকল প্রশ্নের উত্তর দেবে।

যাকাত শুধু একটি ধর্মীয় বিধানই নয়, এটি একটি সামাজিক দায়িত্বও বটে। এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার মাধ্যমে আমরা সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারি এবং গরিব-অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। তাই আসুন, এই ব্লগ পোস্টের মাধ্যমে যাকাত সম্পর্কে সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিই এবং আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি।

যাকাত শব্দের অর্থ কি

যাকাত শব্দটি আরবি “زكاة” (Zakat) থেকে এসেছে, যার অর্থ হল “পবিত্রকরণ” বা “শুদ্ধিকরণ”। ইসলামে, যাকাত একটি ধর্মীয় দায়িত্ব এবং এটি ইসলামিক বিধান অনুসারে সম্পদ থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ (সাধারণত ২.৫%) দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করার জন্য দেওয়া হয়। এটি আর্থিক ও সামাজিক সুষমতা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে এবং একজন মুসলিমের সম্পদকে পবিত্র করে তোলে।

যাকাত কাকে বলে

যাকাত হল ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মুসলিমদের ওপর একটি আর্থিক দান হিসেবে ফরজ করা হয়েছে। এটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ (সাধারণত ২.৫%) দরিদ্র, অনাথ, মিসকিন (দারিদ্র্যকাতর ব্যক্তি), যাত্রী, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় মানুষদের সহায়তা করার জন্য দেয়া হয়।

এটি শুধুমাত্র তাদের ওপর ফরজ, যারা নির্দিষ্ট পরিমাণে সম্পদ বা দানে অধিকারী (নিসাব) এবং এক বছর ধরে সেই সম্পদ রাখে। যাকাত দেওয়ার মাধ্যমে মুসলিমরা তাদের সম্পদকে শুদ্ধ ও পবিত্র করেন এবং সামাজিক সহানুভূতি এবং সাহায্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

যাকাত কাদের উপর ফরজ

যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। এই শর্তগুলো নিম্নরূপ:

১. নিসাব পরিমাণ সম্পদ: যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকা আবশ্যক। এই পরিমাণকে “নিসাব” বলা হয়।
২. সম্পদের উপর এক বছর পূর্ণ হওয়া: নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর ধরে থাকলে যাকাত ফরজ হয়।
৩. মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ: সম্পদের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে যাকাতদাতার হাতে থাকতে হবে।
৪. প্রয়োজনীয় সম্পদ ছাড়া অতিরিক্ত সম্পদ: বেসিক প্রয়োজনীয় সম্পদ (যেমন: বাসস্থান, গাড়ি, পোশাক) যাকাতের আওতায় পড়ে না।

বর্তমানে কত টাকা থাকলে যাকাত ফরজ হয়?

যাকাতের নিসাব পরিমাণ নির্ধারিত হয় স্বর্ণ, রৌপ্য বা নগদ টাকার মূল্য অনুযায়ী। ইসলামী শরীয়তে নিসাবের পরিমাণ নিম্নরূপ:

  • স্বর্ণের নিসাব: ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ (৭.৫ তোলা)
  • রৌপ্যের নিসাব: ৫৯৫ গ্রাম রৌপ্য (৫২.৫ তোলা)
  • নগদ টাকা বা অন্যান্য সম্পদ: স্বর্ণ বা রৌপ্যের নিসাবের সমমূল্যের সম্পদ

২০২৪ সালের বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী, স্বর্ণের দাম প্রতি গ্রাম ৭,০০০ টাকা ধরে নিলে:

  • ৮৫ গ্রাম স্বর্ণের মূল্য = ৮৫ × ৭,০০০ = ৫,৯৫,০০০ টাকা

অর্থাৎ, বর্তমানে কারো কাছে নগদ টাকা, সোনা-রূপা বা অন্যান্য সম্পদ মিলিয়ে ৫,৯৫,০০০ টাকা বা তার বেশি পরিমাণ সম্পদ থাকলে এবং তা এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ফরজ হয়।

যাকাতের হিসাব কীভাবে করবেন?

যাকাতের হিসাব করার জন্য নিম্নলিখিত ধাপগুলো অনুসরণ করুন:

১. সম্পদের পরিমাণ নির্ধারণ: আপনার মোট সম্পদ (নগদ টাকা, সোনা-রূপা, ব্যবসায়িক পণ্য, বিনিয়োগ ইত্যাদি) হিসাব করুন।
২. ঋণ ও দায়বদ্ধতা বাদ দিন: যদি আপনার উপর ঋণ বা দায়বদ্ধতা থাকে, তা সম্পদ থেকে বাদ দিন।
৩. নিসাব পরিমাণ যাচাই করুন: যদি সম্পদের পরিমাণ নিসাবের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে যাকাত ফরজ।
৪. যাকাতের পরিমাণ গণনা করুন: মোট সম্পদের ২.৫% (বা ১/৪০ অংশ) যাকাত হিসেবে প্রদান করুন।

উদাহরণ:
ধরুন, আপনার কাছে ১০,০০,০০০ টাকা নগদ এবং ৫০ গ্রাম সোনা আছে। সোনার বর্তমান মূল্য ৩,৫০,০০০ টাকা। তাহলে মোট সম্পদ = ১০,০০,০০০ + ৩,৫০,০০০ = ১৩,৫০,০০০ টাকা।
যাকাতের পরিমাণ = ১৩,৫০,০০০ × ২.৫% = ৩৩,৭৫০ টাকা।

যাকাতের আটটি খাত কি কি

১. ফকীর (Fakir) – যাদের কোনও সম্পদ নেই বা যারা জীবিকার জন্য সংগ্রাম করছেন এবং তাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য সাহায্য প্রয়োজন।

২. মিসকীন (Miskin) – যাদের সামান্য সম্পদ রয়েছে, তবে তা দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে অক্ষম, অর্থাৎ, তারা দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন যাপন করছেন।

৩. আমিল (Aamil) – যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণ করার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি বা দল। তাদেরকে যাকাত থেকে বেতন দেওয়ার অনুমতি রয়েছে।

৪. মুয়ালাফাতুল কুলুব (Muallafatu al-Qulub) – যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন বা যাদের ইসলাম গ্রহণের দিকে আগ্রহী এবং ইসলাম গ্রহণের পর তাদের সাহায্য করা প্রয়োজন।

৫. রীযাদ (Riqaab) – যারা দাসত্ব বা বন্দিত্বের শিকার, অর্থাৎ মুক্তি পেতে বা মুক্তি পাওয়ার জন্য টাকা প্রয়োজন।

৬. ঘরমুখী যাত্রী (Ibn as-Sabil) – তারা যারা সফরে আছেন এবং তাদের উপার্জন শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন।

৭. ঋণগ্রস্ত (Gharimin) – যারা ঋণের কারণে সংকটে পড়েছেন এবং তাদের ঋণ পরিশোধের জন্য যাকাত গ্রহণ করতে পারেন।

৮. ফি সাবিলিল্লাহ (Fi Sabilillah) – যারা আল্লাহর পথে, যেমন শিক্ষা বা ধর্মীয় কাজের জন্য, কঠোর পরিশ্রম করছেন এবং তাদের সহায়তা প্রয়োজন।

এই আটটি খাতের মধ্যে যাকাত বিতরণ করা যেতে পারে, যাতে সঠিকভাবে যাকাতের উদ্দেশ্য এবং ইসলামিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।

সর্বনিম্ন কত টাকা থাকলে যাকাত দিতে হবে?

যাকাত দেওয়ার জন্য যদি আপনার কাছে ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা বা তার অধিক সোনার সমমূল্য সম্পদ থাকে, অথবা ৪৫ হাজার টাকা বা তার অধিক রূপার সমমূল্য সম্পদ থাকে, তবে যাকাত ফরজ হবে।

যাকাতের জন্য যেই সম্পদে এক বছর (হিজরি বছর) সঞ্চয় থাকে এবং নিসাব পরিমাণ সম্পদ হয়, সে সম্পদ থেকে যাকাত দিতে হবে।

যাকাতের গুরুত্ব

যাকাত শুধু একটি আর্থিক ইবাদত নয়, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে:

  • গরিব ও অসহায় মানুষের সাহায্য করা হয়।
  • সম্পদের সঠিক বণ্টন নিশ্চিত হয়।
  • সমাজে সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা কমে।
  • ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটে।

কত ভরি স্বর্ণ থাকলে যাকাত দিতে হয়?

যাকাত দেওয়ার জন্য যেসব শর্ত রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো নিসাব পরিমাণ সোনা থাকা। ইসলামের দৃষ্টিতে, ৭৫১ গ্রাম সোনা বা ১ ভরি = ১১.৬৬ গ্রাম সোনা হলে, সেটি নিসাব পরিমাণ হয়ে থাকে, এবং তখন যাকাত ফরজ হয়।

অর্থাৎ, ৭৫১ গ্রাম সোনার সমপরিমাণ সোনা যদি আপনার কাছে থাকে, তবে যাকাত দিতে হবে। এটি প্রায় ৬৪.৫ ভরি সোনা

সারাংশ: যদি আপনার কাছে ৬৪.৫ ভরি সোনা (৭৫১ গ্রাম) থাকে, তবে আপনাকে যাকাত দিতে হবে।

প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্ন ১: যাকাত শুধু টাকার উপর ফরজ হয়?

উত্তর: না, যাকাত শুধু টাকার উপর নয়, সোনা-রূপা, ব্যবসায়িক পণ্য, পশুসম্পদ এবং অন্যান্য বিনিয়োগের উপরও ফরজ হয়।

প্রশ্ন ২: ঋণ থাকলে যাকাত দিতে হবে কি?

উত্তর: যদি আপনার উপর ঋণ থাকে, তাহলে ঋণের পরিমাণ সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে বাকি সম্পদের উপর যাকাত দিতে হবে।

প্রশ্ন ৩: যাকাত কাকে দেওয়া যাবে?

উত্তর: যাকাত শুধু গরিব, অসহায়, ঋণগ্রস্ত এবং মুসাফিরদের দেওয়া যাবে। নিকটাত্মীয়দের দেওয়া উত্তম, তবে যাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আপনার উপর আছে, তাদের দেওয়া যাবে না।

প্রশ্ন ৪: যাকাতের টাকা দান হিসেবে গণ্য হয় কি?

উত্তর: না, যাকাত একটি ফরজ ইবাদত এবং দান (সদকা) একটি নফল ইবাদত। যাকাতের টাকা দান হিসেবে গণ্য করা যায় না।

উপসংহার

যাকাত ইসলামের একটি মৌলিক বিধান এবং এটি মুসলমানদের আর্থিক ও সামাজিক দায়িত্বের প্রতীক। ২০২৪ সালের বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী, যাকাত ফরজ হওয়ার নিসাব পরিমাণ ৫,৯৫,০০০ টাকা। এই পরিমাণ সম্পদ থাকলে এবং তা এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত প্রদান করা আবশ্যক। যাকাতের মাধ্যমে আমরা সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারি এবং গরিব-অসহায় মানুষের সাহায্য করতে পারি।

গুগল নিউজে SS IT BARI সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন

👉🙏লেখার মধ্যে ভাষা জনিত কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

✅আজ এ পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন 🤔

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আমি মো:সানাউল বারী।পেশায় আমি একজন চাকুরীজীবী এবং এই ওয়েবসাইটের এডমিন। চাকুরীর পাশাপাশি গত ১৪ বছর থেকে এখন পর্যন্ত নিজের ওয়েবসাইটে লেখালেখি করছি এবং নিজের ইউটিউব এবং ফেসবুকে কনটেন্ট তৈরি করি। বিশেষ দ্রষ্টব্য -লেখার মধ্যে যদি কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকে অবশ্যই ক্ষমার চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ।