ইসলাম ধর্মে ফিতরা বা ফিতরাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা রমজান মাসের শেষে ঈদুল ফিতরের আগে আদায় করা হয়। এটি শুধুমাত্র একটি দানই নয়, বরং এটি রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণ এবং গরীব-অসহায় মানুষের মাঝে ঈদের আনন্দ বিলিয়ে দেওয়ার একটি মাধ্যম। ফিতরা দেওয়ার মাধ্যমে একজন মুসলিম তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেন।
তবে ফিতরা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, “ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে?” এই প্রশ্নের উত্তর জানা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ফিতরা সঠিক ব্যক্তিকে না দিলে এর সওয়াব পাওয়া যায় না। এই ব্লগ পোস্টে আমরা ফিতরা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে আপনি সঠিকভাবে ফিতরা আদায় করতে পারেন এবং এর গুরুত্ব ও নিয়মাবলী সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা পেতে পারেন।
ফিতরা দেওয়ার নিয়ম, এর পরিমাণ, কাকে দেওয়া যাবে এবং কাকে দেওয়া যাবে না—এসব বিষয় নিয়ে আমরা এই পোস্টে আলোচনা করব। পাশাপাশি ফিতরা দেওয়ার গুরুত্ব এবং ইসলামিক শরীয়াহ অনুযায়ী এর বিধান নিয়েও বিস্তারিত তথ্য শেয়ার করা হবে। এই পোস্টটি পড়ে আপনি ফিতরা সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ ধারণা পাবেন এবং সঠিকভাবে ফিতরা আদায় করতে সক্ষম হবেন।
Also Read
চলুন, শুরু করা যাক ফিতরা সম্পর্কে এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।
ফিতরা অর্থ কি
ফিতরা (ফিতরাহ) আরবি শব্দ, যার অর্থ “ভাঙ্গা”। এটি রমজান মাসের রোজা ভাঙ্গার সাথে সম্পর্কিত। ফিতরা হলো একটি দান, যা রমজান মাস শেষে ঈদের আগে আদায় করা হয়। এটি গরীব ও অসহায় মানুষের মাঝে বণ্টন করা হয়, যাতে তারা ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে।
আরও–বমি করলে কি রোজা ভেঙে যায়?
ফিতরা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি নয়, তবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণ করে এবং গরীবদের সাহায্য করে।
ফিতরা দেওয়ার নিয়ম
ফিতরা দেওয়ার কিছু নিয়ম রয়েছে, যা ইসলামিক শরীয়াহ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়েছে। নিচে ফিতরা দেওয়ার নিয়মগুলো আলোচনা করা হলো:
ফিতরা দেওয়ার সময়
ফিতরা রমজান মাস শেষে ঈদুল ফিতরের আগে আদায় করতে হয়। সাধারণত ঈদের দিন সকালে নামাজের আগে ফিতরা দেওয়ার রীতি রয়েছে। তবে রমজান মাসের শেষ দিকে বা ঈদের আগের দিনও ফিতরা দেওয়া যায়।
ফিতরার পরিমাণ
ইসলামে ফিতরা (ফিতরাহ) হলো রমজান মাসের শেষে ঈদুল ফিতরের আগে গরিব ও অসহায় মানুষদের সাহায্যার্থে প্রদান করা একটি বাধ্যতামূলক দান। ফিতরার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় প্রধান খাদ্যশস্যের ভিত্তিতে, যা স্থানীয়ভাবে প্রচলিত। সাধারণত ফিতরার পরিমাণ হলো একজন মানুষের এক দিনের খাদ্য প্রয়োজনীয়তার সমতুল্য।
- গম বা গমের আটার ভিত্তিতে: প্রায় ২.৫ কেজি গম বা এর মূল্য।
- যব, খেজুর বা কিসমিসের ভিত্তিতে: প্রায় ৫ কেজি।
ফিতরার মূল্য স্থানীয় বাজারদর অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। সাধারণত ইসলামিক স্কলার বা স্থানীয় মসজিদ কমিটি প্রতি বছর ফিতরার ন্যূনতম মূল্য ঘোষণা করে। উদাহরণস্বরূপ:
- ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ফিতরার ন্যূনতম মূল্য প্রায় ২০০-৩০০ টাকা (গমের ভিত্তিতে)।
ফিতরার উদ্দেশ্য হলো ঈদের দিন গরিব-অসহায় মানুষদেরও যেন ঈদের আনন্দে শরিক হওয়ার সুযোগ হয় এবং তাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণ হয়।
ফিতরার পরিমাণ ও মূল্য স্থানীয় প্রচলিত নিয়ম ও ইসলামিক স্কলারদের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রদান করা উচিত।
ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে
ফিতরা শুধুমাত্র গরীব ও অসহায় মানুষকে দেওয়া যায়। যারা জাকাত পাওয়ার যোগ্য, তারাই ফিতরা পাওয়ারও যোগ্য। নিচে ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে তার তালিকা দেওয়া হলো:
- গরীব ও অসহায় মানুষ
- ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি
- মুসাফির (যাত্রী)
- ইসলাম প্রচারক
- নতুন মুসলিম
ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে না
ফিতরা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু ব্যক্তি বাদ পড়েন। নিচে ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে না তার তালিকা দেওয়া হলো:
- ধনী ব্যক্তি
- নিজের পরিবার (স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা)
- অমুসলিম
- যারা ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করে
ফিতরা কাদের উপর ওয়াজিব
ফিতরা, যাকে জাকাতুল ফিতরও বলা হয়, ইসলাম ধর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। এটি ঈদুল ফিতরের দিনে দরিদ্র ও প্রয়োজনমাফিক মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়। ফিতরা ওয়াজিব হওয়ার শর্তগুলি নিম্নরূপ:
১. মুসলিম হওয়া: ফিতরা শুধুমাত্র মুসলিমদের উপর ওয়াজিব।
২. স্বাধীন হওয়া: দাস বা বন্দী ব্যক্তির উপর ফিতরা ওয়াজিব নয়।
৩. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া: ঈদুল ফিতরের দিন সূর্যাস্তের সময় যদি কারো কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তবে তার উপর ফিতরা ওয়াজিব। নিসাব হলো সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ সম্পদ।
৪. প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা পূরণের অতিরিক্ত সম্পদ থাকা: যদি কারো কাছে প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা (যেমন: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি) পূরণের অতিরিক্ত সম্পদ থাকে, তবে তার উপর ফিতরা ওয়াজিব।
৫. ঈদুল ফিতরের দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত জীবিত থাকা: ঈদুল ফিতরের দিন সূর্যাস্তের সময় যদি কেউ জীবিত থাকে, তবে তার উপর ফিতরা ওয়াজিব।
ফিতরা সাধারণত গম, যব, খেজুর, কিসমিস বা অন্যান্য স্থানীয় প্রধান খাদ্যশস্য দ্বারা আদায় করা হয়। বর্তমানে অনেক স্থানে ফিতরার মূল্য নির্ধারণ করে তা টাকার মাধ্যমে আদায় করা হয়। ফিতরা দরিদ্র ও প্রয়োজনমাফিক মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়, যাতে তারা ঈদের আনন্দে অংশ নিতে পারে।
ফিতরা দেওয়ার গুরুত্ব
ফিতরা দেওয়ার অনেক গুরুত্ব রয়েছে ইসলামে। এটি শুধু গরীবদের সাহায্য করা নয়, বরং রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণ করার একটি মাধ্যম। নিচে ফিতরা দেওয়ার গুরুত্ব আলোচনা করা হলো:
১. রোজার ত্রুটি পূরণ
রোজা রাখার সময় অনেক সময় অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়ে যায়। ফিতরা দেওয়ার মাধ্যমে এই ত্রুটি পূরণ করা হয়।
২. গরীবদের সাহায্য
ফিতরা গরীব ও অসহায় মানুষের মাঝে বণ্টন করা হয়। এটি তাদের ঈদের আনন্দে শরিক হতে সাহায্য করে।
৩. সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা
ফিতরা দেওয়ার মাধ্যমে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। এটি ধনী ও গরীবের মধ্যে ব্যবধান কমায়।
৪. আল্লাহর সন্তুষ্টি
ফিতরা দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। এটি একটি সদকাহ, যা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়।
ফিতরা দেওয়ার হিসাব
ফিতরা দেওয়ার হিসাব ইসলামিক শরীয়াহ অনুযায়ী নির্ধারিত। এটি সাধারণত গম, যব, খেজুর বা কিসমিসের মাধ্যমে আদায় করা হয়। বর্তমানে ফিতরার পরিমাণ টাকার অঙ্কে নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশন ফিতরার পরিমাণ প্রকাশ করে।
ফিতরার পরিমাণ
- গম: ২ কেজি ৪০ গ্রাম
- যব: ৪ কেজি ৮০ গ্রাম
- খেজুর: ৩ কেজি ৬০ গ্রাম
- কিসমিস: ৩ কেজি ৬০ গ্রাম
বর্তমানে ফিতরার পরিমাণ টাকার অঙ্কে নির্ধারণ করা হয়। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ফিতরার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ১২০ টাকা থেকে ২,০০০ টাকা পর্যন্ত।
ফিতরা কত টাকা ২০২৫
২০২৫ সালে ফিতরার নির্দিষ্ট পরিমাণ বা মূল্য এখনো জানা যায়নি, কারণ এটি প্রতি বছর স্থানীয় বাজারদর এবং ইসলামিক স্কলারদের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। সাধারণত, রমজান মাসের শেষের দিকে বা ঈদুল ফিতরের আগে ইসলামিক স্কলার বা স্থানীয় মসজিদ কমিটি ফিতরার ন্যূনতম মূল্য ঘোষণা করে।
ফিতরার মূল্য স্থানীয়ভাবে প্রচলিত প্রধান খাদ্যশস্য (যেমন গম, যব, খেজুর ইত্যাদি) এর বাজারমূল্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। উদাহরণস্বরূপ:
- গমের ভিত্তিতে: ২.৫ কেজি গম বা এর মূল্য।
- যব বা খেজুরের ভিত্তিতে: ৫ কেজি যব বা খেজুর বা এর মূল্য।
২০২৩ সালে বাংলাদেশে ফিতরার ন্যূনতম মূল্য ছিল প্রায় ২০০-৩০০ টাকা (গমের ভিত্তিতে)। প্রতি বছর মুদ্রাস্ফীতি এবং বাজারদরের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই মূল্য সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে।
২০২৫ সালে ফিতরার সঠিক মূল্য জানতে রমজান মাসে স্থানীয় মসজিদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বা বিশ্বস্ত ইসলামিক স্কলারদের নির্দেশনা অনুসরণ করুন। সাধারণত ঈদের কয়েক দিন আগেই এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
প্রশ্ন-উত্তর
১. ফিতরা কী?
ফিতরা হলো একটি দান, যা রমজান মাস শেষে ঈদুল ফিতরের আগে আদায় করা হয়। এটি গরীব ও অসহায় মানুষের মাঝে বণ্টন করা হয়।
২. ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে?
ফিতরা শুধুমাত্র গরীব ও অসহায় মানুষকে দেওয়া যায়। যারা জাকাত পাওয়ার যোগ্য, তারাই ফিতরা পাওয়ারও যোগ্য।
৩. ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে না?
ফিতরা ধনী ব্যক্তি, নিজের পরিবার, অমুসলিম এবং যারা ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করে, তাদের দেওয়া যাবে না।
৪. ফিতরা দেওয়ার সময় কখন?
ফিতরা রমজান মাস শেষে ঈদুল ফিতরের আগে আদায় করতে হয়। সাধারণত ঈদের দিন সকালে নামাজের আগে ফিতরা দেওয়ার রীতি রয়েছে।
৫. ফিতরার পরিমাণ কত?
ফিতরার পরিমাণ ইসলামিক শরীয়াহ অনুযায়ী নির্ধারিত। এটি সাধারণত গম, যব, খেজুর বা কিসমিসের মাধ্যমে আদায় করা হয়। বর্তমানে ফিতরার পরিমাণ টাকার অঙ্কে নির্ধারণ করা হয়।
উপসংহার
ফিতরা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা রমজান মাস শেষে ঈদুল ফিতরের আগে আদায় করা হয়। এটি গরীব ও অসহায় মানুষের মাঝে বণ্টন করা হয়, যাতে তারা ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে। ফিতরা দেওয়ার মাধ্যমে রোজার ত্রুটি পূরণ করা যায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।
ফিতরা কাকে দেওয়া যাবে এবং কাকে দেওয়া যাবে না, তা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফিতরা শুধুমাত্র গরীব ও অসহায় মানুষকে দেওয়া যায়। এটি ইসলামিক শরীয়াহ অনুযায়ী নির্ধারিত নিয়মে আদায় করতে হয়।
গুগল নিউজে SS IT BARI সাইট ফলো করতে এখানে ক্লিক করুন তারপর ফলো করুন
👉🙏লেখার মধ্যে ভাষা জনিত কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
✅আজ এ পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন 🤔