ইসলাম ধর্মে জুমার দিনকে সপ্তাহের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দিন হিসেবে গণ্য করা হয়। এই দিনে মুসলমানদের জন্য জুমার নামাজ আদায় করা ফরজ ইবাদত, যার বিশেষ ফজিলত ও গুরুত্ব রয়েছে কোরআন ও হাদিসে। অনেকেই জানতে চান — “জুমার নামাজ কত রাকাত?”, এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ নামাজের সঠিক রাকাত সংখ্যা ও আদায়ের পদ্ধতি জানাই একজন মুসলমানের জন্য আবশ্যক।
জুমার নামাজ কেবলমাত্র একটি ইবাদত নয়, বরং এটি মুসলিম উম্মাহর মিলনের প্রতীকও। এ নামাজ আদায়ের মাধ্যমে একজন মুসলমান আল্লাহর নৈকট্য লাভের পাশাপাশি সামাজিক বন্ধনও দৃঢ় করে। তবে অনেক মুসল্লি এখনো দ্বিধায় থাকেন যে, জুমার ফরজ কত রাকাত, সুন্নত কয়টি এবং অতিরিক্ত নফল আদায়ের বিধান কী?
চলুন জেনে নিই, একজন মুসলমান হিসেবে জুমার নামাজ কিভাবে সঠিকভাবে আদায় করা উচিত।
আরও পড়ুন
জুমার দিনের ফজিলত
জুমার দিন ইসলামের দৃষ্টিতে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ দিন। এই দিনটি সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন হিসেবে চিহ্নিত এবং এতে এমন কিছু বিশেষ আমল ও ঘটনা রয়েছে, যা অন্য কোনো দিনে নেই। নিচে জুমার দিনের ফজিলতসমূহ কোরআন ও হাদিসের আলোকে তুলে ধরা হলো:
সপ্তাহের সেরা দিন
হাদিস:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন –
“সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বশ্রেষ্ঠ। এই দিনেই আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।”
📚 [সহিহ মুসলিম: ৮৫৪]
গুনাহ মাফের সুযোগ
হাদিস:
“যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে, এরপর জুমার নামাজের জন্য আসে, মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনে এবং চুপ থাকে, তার এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত সময়ের গুনাহ মাফ হয়ে যায় এবং আরও অতিরিক্ত তিন দিনের গুনাহ মাফ হয়।”
📚 [সহিহ মুসলিম: ৮৫৭]
জুমার নামাজ ফরজ করা হয়েছে
আল-কুরআনের বাণী:
“হে ঈমানদারগণ! যখন জুমার দিনে নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা পরিত্যাগ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জানো।”
📖 [সূরা জুমু’আহ: আয়াত ৯]
এ আয়াতে স্পষ্টভাবে জুমার নামাজ ফরজ হওয়ার নির্দেশ এসেছে।
জুমার দিন বিশেষ মুহূর্ত আছে, যখন দোয়া কবুল হয়
হাদিস:
“জুমার দিনে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে, যখন কোনো মুসলমান বান্দা সে মুহূর্তে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তা অবশ্যই কবুল হয়।”
📚 [সহিহ বুখারি ও মুসলিম]
অনেক আলেম বলেন, এ মুহূর্তটি আসরের পর থেকে মাগরিবের আগে পর্যন্ত হতে পারে।
জুমার খুতবা ও জামাত মুসলিম ঐক্যের প্রতীক
জুমার নামাজে খুতবার মাধ্যমে ইমাম সমাজকে উপদেশ দেন, যা মুসলিম সমাজে জ্ঞান ও ঐক্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
জুমার দিনে দরুদ পড়ার বিশেষ ফজিলত
হাদিস:
“তোমরা জুমার দিনে আমার উপর বেশি বেশি দরুদ পড়ো, কারণ এই দিন আমার উম্মতের দরুদ আমার নিকট পেশ করা হয়।”
📚 [আবু দাউদ: ১৫৩১]
জুমার দিন সদকা করার ফজিলত
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন:
“জুমার দিনে সদকা অন্যান্য দিনের তুলনায় অধিক মর্যাদাপূর্ণ ও পুণ্যময়।”
জুমার দিনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল
-
গুসল (স্নান) করা
-
পরিষ্কার পোশাক পরা
-
আগেভাগে মসজিদে যাওয়া
-
খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনা
-
বেশি বেশি দরুদ পাঠ
-
দোয়া করা
-
সূরা কাহফ তিলাওয়াত
জুমার দিন হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য এক অপূর্ব নিয়ামত। এই দিনের ফজিলত অর্জনের জন্য আমাদের উচিত জুমার নামাজ যথাযথভাবে আদায় করা, পবিত্রতা রক্ষা করা এবং খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনা। এ দিনের দোয়া, দরুদ ও কুরআন তিলাওয়াত আমাদের আমলনামা ভারী করে তুলতে পারে।
জুমার নামাজ মোট কত রাকাত কি কি
জুমার নামাজের মূল ফরজ অংশ ২ রাকাত, যা ইমামের সঙ্গে জামাতে আদায় করতে হয়। তবে সুন্নত ও নফল নামাজসহ মোট রাকাত সংখ্যা সাধারণত ১০ হয়। এর বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো:
-
চার রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা (কাবলাল জুমা): জুমার খুতবার আগে আদায় করা হয়।
🕋 জুমার আগের চার রাকাত সুন্নতের নিয়ত
উচ্চারণ:
“নওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা আরবাআ রাকা’আতি সুন্নাতিল জুমা’তি লিল্লাহি তা’আলা”
বাংলা অনুবাদ:
আমি নিয়ত করলাম জুমার আগের চার রাকাত সুন্নত নামাজ আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশ্যে আদায় করার।
-
দুই রাকাত ফরজ: ইমামের সঙ্গে জামাতে আদায় করা হয়।
🕌 জুমার নামাজের ফরজ ২ রাকাতের নিয়ত (বাংলায় উচ্চারণ)
نويت أن أصلي لله تعالى ركعتين فرض الجمعة مأموما لله تعالى
উচ্চারণ:
“নওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাক’আতাইনি ফারদাল জুমা’তি মাআল ইমামি লিল্লাহি তা’আলা”
বাংলা অনুবাদ:
আমি নিয়ত করলাম দুই রাকাত জুমার ফরজ নামাজ ইমামের সঙ্গে আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশ্যে আদায় করার।
-
চার রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা (বাদাল জুমা): ফরজ নামাজের পরে আদায় করা হয়।
🕋 জুমার পরের চার রাকাত সুন্নতের নিয়ত
উচ্চারণ:
“নওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা আরবাআ রাকা’আতি সুন্নাতিল বাদাল জুমা’তি লিল্লাহি তা’আলা”
বাংলা অনুবাদ:
আমি নিয়ত করলাম জুমার পরে চার রাকাত সুন্নত নামাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে আদায় করার।
অনেক মুসল্লি অতিরিক্ত ২ রাকাত নফল নামাজও আদায় করে থাকেন। তবে এটি আবশ্যক নয়।
ইমামের পিছনে জুমার নামাজের নিয়ত
জুমার নামাজে ইমামের পেছনে ফরজ ২ রাকাত আদায় করা হয়। এ অবস্থায় নিয়ত একটু ভিন্নভাবে করা হয়, যেখানে উল্লেখ থাকে যে আপনি ইমামের পেছনে নামাজ পড়ছেন।
নিচে ইমামের পেছনে জুমার ফরজ নামাজের নিয়ত বাংলায় উচ্চারণসহ দেওয়া হলো:
🕌 ইমামের পিছনে জুমার ফরজ নামাজের নিয়ত (বাংলায় উচ্চারণ)
আরবি নিয়ত:
نويت أن أصلي لله تعالى ركعتين فرض الجمعة مأموماً لله تعالى
বাংলা উচ্চারণ:
“নওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাক’আতাইনি ফারদাল জুমা’তি মা’আল ইমামি লিল্লাহি তা’আলা”
বাংলা অনুবাদ:
আমি নিয়ত করলাম জুমার দুই রাকাত ফরজ নামাজ ইমামের সঙ্গে আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশ্যে আদায় করার।
🔹 মনে রাখতে হবে: নিয়ত মূলত হৃদয়ের ইচ্ছা। মুখে উচ্চারণ না করলেও মন থেকে নিয়ত করলেই তা গ্রহণযোগ্য। মুখে বলা শুধু শেখার জন্য এবং মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার জন্য সহায়ক।
জুমার নামাজের আদায়ের নিয়ম
-
গোসল ও প্রস্তুতি: জুমার দিন গোসল করা সুন্নত। পরিচ্ছন্ন পোশাক পরিধান করে সুগন্ধি ব্যবহার করা উত্তম।
-
মসজিদে আগমন: সময়মতো মসজিদে উপস্থিত হয়ে খুতবা শোনা আবশ্যক। খুতবা চলাকালীন নীরবতা পালন করতে হয়।
-
নামাজের আদায়: খুতবার পর ইমামের সঙ্গে ২ রাকাত ফরজ নামাজ জামাতে আদায় করতে হয়।
-
সুন্নত ও নফল নামাজ: ফরজের আগে ও পরে সুন্নত নামাজ আদায় করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। অতিরিক্ত নফল নামাজ আদায় করা ইচ্ছাধীন।
জুমার নামাজের গুরুত্ব
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:
“হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা পরিত্যাগ কর। এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে, যথাসময়ে মসজিদে আসে, খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং চুপ থাকে, তার এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত এবং অতিরিক্ত তিন দিনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।”
উপসংহার
জুমার নামাজ ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা মুসলমানদের জন্য বিশেষ ফজিলতের অধিকারী। সঠিক নিয়মে এবং সময়মতো এই নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।
👉🙏লেখার মধ্যে ভাষা জনিত কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
✅আজ এ পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন 🤔