বাংলাদেশে জমির মালিকানা পরিবর্তন বা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে নামজারি (Mutation) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। আগে এই কাজটি করতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো, দালালের পেছনে ঘোরা, বারবার অফিসে যাতায়াত করা—এসব ছিল খুবই সাধারণ সমস্যা। এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগের ফলে অনলাইনের মাধ্যমে খুব সহজেই ঘরে বসেই জমির নামজারি আবেদন করা যায়। মাত্র কয়েকটি ডকুমেন্ট এবং কিছু সহজ ধাপ অনুসরণ করলেই আপনি সম্পূর্ণ অনলাইন প্রক্রিয়ায় নামজারি করে নিতে পারবেন।
আরও পড়ুন-জমি রেজিস্ট্রি খরচ কত ২০২৫-২০২৬ – সর্বশেষ ফি, ট্যাক্স ও নিবন্ধন প্রক্রিয়া জানুন
নামজারি কী এবং কেন এটি প্রয়োজন?
নামজারি হলো জমির মালিকানার রেকর্ড সরকারিভাবে পরিবর্তন করে নতুন মালিকের নামে হালনাগাদ করা।
যেমন:
-
আপনি জমি কিনলেন,
-
উত্তরাধিকার সূত্রে জমি পেলেন,
-
হেবার মাধ্যমে মালিকানা হস্তান্তর হলো,
-
রায়/ডিক্রি অনুযায়ী মালিকানা পরিবর্তন হলো—
এই সব ক্ষেত্রেই নতুন মালিকের নামে নামজারি করা বাধ্যতামূলক।
নামজারি না থাকলে—
✘ জমির খাজনা দিতে পারবেন না
✘ ভবিষ্যতে বিক্রি বা রেজিস্ট্রি করতে সমস্যা হবে
✘ জমি নিয়ে আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে
অনলাইনে জমির নামজারি করার নিয়ম
বাংলাদেশ সরকারের Land.gov.bd এবং e-Mutation (ই-মিউটেশন) পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে নামজারি আবেদন করা যায়।
ধাপ–১: ই-মিউটেশন পোর্টালে প্রবেশ করুন
অনলাইনে নামজারির জন্য ভিজিট করুন:
👉 https://land.gov.bd
এছাড়া আপনি সরাসরি e-mutation পোর্টালেও যেতে পারেন।
হোমপেইজে গিয়ে “নামজারি আবেদন করুন (Apply for Mutation)” বাটনে ক্লিক করুন।
ধাপ–২: অ্যাকাউন্ট তৈরি বা লগইন করুন
প্রথমবার আবেদন করতে হলে—
✓ মোবাইল নম্বর
✓ জাতীয় পরিচয়পত্র
✓ OTP কোড
এসব দিয়ে একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করে লগইন করুন।
পূর্বে অ্যাকাউন্ট থাকলে সরাসরি লগইন করুন।
ধাপ–৩: আবেদন ফরম পূরণ করুন
এটি নামজারি আবেদনের মূল ধাপ। এখানে কিছু তথ্য দিতে হবে:
যে তথ্যগুলো আবশ্যক—
- জেলা, উপজেলা ও মৌজা নির্বাচন
- খতিয়ান নম্বর
- দাগ নম্বর
- জমির পরিমাণ
- হস্তান্তর বা মালিকানার ধরন (ক্রয়/উত্তরাধিকার/হেবা ইত্যাদি)
- ওয়ারিশের সংখ্যা (যদি উত্তরাধিকার হয়)
- মালিকের NID তথ্য
- রেজিস্ট্রি ডিডের নম্বর ও তারিখ (ক্রয়ের ক্ষেত্রে)
সঠিক তথ্য দিতে ভুল করবেন না। ভুল তথ্য দিলে আবেদন বাতিল হয়ে যেতে পারে।
ধাপ–৪: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্ক্যান করে আপলোড করুন
নিচে নামজারি প্রক্রিয়ায় যে সকল কাগজপত্র লাগবে তা উল্লেখ করা হলো:
১. ক্রয়ের মাধ্যমে হলে:
-
রেজিস্ট্রি করা বিক্রয় দলিল
-
ই-দলিল কপি (যদি থাকে)
-
খাজনার রশিদ
-
দাগ-খতিয়ান কপি (CS/RS/BS/S.A)
-
নতুন মালিকের NID
-
মালিকানা হস্তান্তরের নথিপত্র
-
ওয়ারিশ সনদ (যদি পূর্বের মালিক মারা যান)
২. উত্তরাধিকার সূত্রে নামজারি হলে:
-
মৃত ব্যক্তির মৃত্যু সনদ
-
ওয়ারিশ সনদ
-
খাজনার রশিদ
-
খতিয়ান কপি
-
প্রতিটি ওয়ারিশের NID
৩. হেবার মাধ্যমে হলে:
-
হেবা দলিল
-
NID (উভয় পক্ষের)
-
খাজনার রশিদ
-
জমির দাগ/খতিয়ান কপি
ফাইল আপলোড ফরম্যাট:
✓ PDF / JPG / JPEG
✓ সাইজ 2MB–10MB এর মধ্যে
ধাপ–৫: আবেদন ফি পরিশোধ করুন
অনলাইনে নামজারি ফি খুবই কম। মোবাইল ব্যাংকিং (bKash, Nagad, Rocket), Sonali Payment Gateway, Debit/Credit Card—যে কোনো মাধ্যমে পেমেন্ট করা যায়।
জমির নামজারি করার সরকারি ফি
| খাত | পরিমাণ |
|---|---|
| নামজারি আবেদন ফি | ২৫ টাকা |
| নামজারি খতিয়ান ফি | ৫০ টাকা |
| নকল খতিয়ান/কপি | ৫০–১০০ টাকা |
| অনলাইন পেমেন্ট চার্জ | ৫–১৫ টাকা (সেবা অনুযায়ী) |
| মোট খরচ সাধারণত | ১০০–২০০ টাকা |
দালালের কাছে গেলে ৩,০০০–১০,০০০ টাকা পর্যন্ত বেশি খরচ হতে পারে। তাই অনলাইনেই আবেদন করাই উত্তম।
ধাপ–৬: আবেদন সাবমিট করার পর রিসিভিং পাবেন
আবেদন জমা দিলে আপনি একটি “Application ID (Tracking Number)” পাবেন।
এটি দিয়ে পরে আপনার আবেদনের স্ট্যাটাস চেক করতে পারবেন।
ধাপ–৭: ইউএনও অফিস/এসি ল্যান্ড অফিসে তদন্ত প্রক্রিয়া
এখন আপনার আবেদনটি জারিকারক কর্মকর্তার কাছে যাবে:
-
সার্ভেয়ার/তহশিলদার মাঠে গিয়ে জমি যাচাই করবে
-
আগের খতিয়ান মিলিয়ে দেখবে
-
দলিল ও মালিকানা পরীক্ষা করা হবে
যদি সবকিছু ঠিক থাকে, তাহলে নামজারি অনুমোদন করা হবে।
সময় লাগে সাধারণত: ৭–২০ কার্যদিবস
ধাপ–৮: এসএমএসের মাধ্যমে অনুমোদনের নোটিশ
আপনার আবেদন অনুমোদিত হলে আপনার মোবাইলে একটি SMS আসবে:
“Your mutation application has been approved.”
এখন আপনি অনলাইন পোর্টাল থেকে নামজারি খতিয়ান দেখে নিতে পারবেন।
অনলাইনে নামজারি কপি (খতিয়ান) ডাউনলোড করার নিয়ম
-
land.gov.bd এ লগইন করুন
-
“Mutation Status” বা “নামজারি স্ট্যাটাস” মেনুতে যান
-
আপনার Application ID দিন
-
স্ট্যাটাস Approved দেখালে Download Mutation Khatian বাটনে ক্লিক করুন
PDF হিসেবে খতিয়ান পাবেন যা যেকোনো জায়গায় ব্যবহারযোগ্য।
নামজারি করতে সবচেয়ে বেশি যেসব ভুলে আবেদন বাতিল হয়
নিচের ভুলগুলো অনেকেই করেন এবং সেগুলার জন্য আবেদন Reject হয়ে যায়—
❌ দলিলে জমির পরিমাণ ভুল
❌ NID নম্বর ভুল বা অস্পষ্ট
❌ দাগ ও খতিয়ান নম্বর ভুল দেয়া
❌ খাজনা রশিদ আপলোড না করা
❌ ওয়ারিশ সনদ ভুল বা অসম্পূর্ণ
❌ স্ক্যান করা কাগজ অস্পষ্ট
এই কারণে আবেদন করার আগে তথ্য মিলিয়ে নিয়ে সাবধানে ফরম পূরণ করতে হবে।
নামজারি সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
✓ জমি কেনার সময় সর্বদা দাগ, খতিয়ান, মালিকানা যাচাই করুন
✓ জমি কেনার পর যত দ্রুত সম্ভব নামজারি করুন
✓ সকল কাগজ স্ক্যান করে PDF আকারে রাখুন
✓ আবেদন আইডি এবং রশিদ সংরক্ষণ করুন
✓ ভবিষ্যতে জমি বিক্রি, ব্যাংক লোন, উত্তরাধিকার—সবকিছুর জন্য নামজারি দরকার
শেষ কথা
ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে এখন অনলাইনে ঘরে বসেই জমির নামজারি করা অত্যন্ত সহজ, দ্রুত, স্বচ্ছ এবং ঝামেলাহীন। অফিসে দালালের পেছনে ঘুরাঘুরি বা অতিরিক্ত টাকা খরচের দরকার নেই। মাত্র কয়েক ধাপে নিজের মোবাইল থেকেই আবেদন করে নামজারি সম্পন্ন করা যায়।
ℹ️ আরও কন্টেন্ট নিয়মিত পেতে- ফেসবুক পেজে যুক্ত থাকুন!
ℹ️ ভিডিও আকারে কনটেন্ট নিয়মিত পেতে –ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন!
আরও পড়ুন-জমির মামলা থেকে বাঁচতে আগে থেকেই যেসব কাজ করবেন
👉🙏লেখার মধ্যে ভাষা জনিত কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
✅আজ এ পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন 🤔


