বাংলাদেশে আজ যখন আমরা স্মার্টফোনে 5G নেটওয়ার্ক, আনলিমিটেড ডেটা প্যাক বা ইন্টারনেট কলের মতো সুবিধা উপভোগ করছি, তখন হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল অপারেটর — সিটিসেল (Citycell)-এর নাম।
একসময় এই সিটিসেলই ছিল দেশের মোবাইল যোগাযোগের পথিকৃৎ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কোম্পানি হারিয়ে গেল ইতিহাসের পাতায়।
আরও পড়ুন-সিটিসেল সিম কি বাংলাদেশে আবার ফিরছে?
বাংলাদেশের টেলিকম যুগের সূর্যোদয়
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন সেবার ইতিহাস শুরু হয় ১৯৯৩ সালে, যখন “Pacific Bangladesh Telecom Limited” নামের প্রতিষ্ঠানটি Citycell ব্র্যান্ড নামে কাজ শুরু করে।
তারা ছিল দেশের প্রথম মোবাইল ফোন অপারেটর এবং একমাত্র কোম্পানি যারা CDMA (Code Division Multiple Access) প্রযুক্তি ব্যবহার করত।
তখন অন্য কোনো অপারেটরই ছিল না। সেই সময় মোবাইল মানে ছিল “সিটিসেল ফোন”!
সেই সময় তাদের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল —
🔊 “Citycell — Clearer Voice, Better Value.”
তারা শহরাঞ্চলে ফোন সংযোগ সহজলভ্য করে তোলে এবং প্রথমবারের মতো মানুষকে মোবাইলের মাধ্যমে যেকোনো জায়গায় কথা বলার সুযোগ দেয়।
সাফল্যের শুরু: কম দামে পরিষ্কার ভয়েস
৯০-এর দশক থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সিটিসেল তাদের নির্ভরযোগ্য ভয়েস কোয়ালিটি এবং তুলনামূলক কম রেটের কারণে জনপ্রিয়তা পায়।
📞 সিটিসেল ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে সস্তা কলরেট প্রদানকারী অপারেটর।
অন-নেট কল ছিল মাত্র ২৫ পয়সা প্রতি মিনিট, যা তখনকার অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে অনেক কম।
এছাড়া তারা “Zoom Ultra” নামের একটি ইন্টারনেট মডেম সার্ভিস চালু করেছিল, যা বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের শুরুর যুগে অনেক জনপ্রিয় ছিল।
কিন্তু ধীরে ধীরে কেন পতন শুরু হলো?
সিটিসেলের পতনের পেছনে কয়েকটি বড় কারণ কাজ করেছে — নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক 👇
পুরনো প্রযুক্তি: CDMA বনাম GSM
সিটিসেল ব্যবহৃত করত CDMA প্রযুক্তি, যেখানে বাকিরা (গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক) ব্যবহার করত GSM।
👉 GSM প্রযুক্তিতে সিম পরিবর্তন সহজ, হ্যান্ডসেট সাপোর্ট বেশি এবং নেটওয়ার্ক স্থিতিশীল।
কিন্তু CDMA ছিল সীমিত, হ্যান্ডসেট নির্ভর এবং ব্যয়বহুল।
ফলে গ্রাহকরা একে একে GSM অপারেটরের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
প্রযুক্তি উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া
যখন অন্যান্য অপারেটররা 2G, 3G, পরে 4G চালু করে, সিটিসেল তখনও পুরনো CDMA-তেই আটকে ছিল।
তারা নতুন নেটওয়ার্কে বিনিয়োগ করতে পারেনি, ফলে ইন্টারনেট স্পিড কম এবং সার্ভিস দুর্বল ছিল।
আর্থিক সংকট ও ঋণের চাপ
সিটিসেল সময়ের সাথে বিপুল ঋণে ডুবে যায়।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC)-এর কাছে তাদের লাইসেন্স ফি, স্পেকট্রাম চার্জ ও ভ্যাট বাবদ কোটি টাকার বকেয়া জমে যায়।
২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, তাদের বকেয়া ছিল প্রায় ৪৭৭ কোটি টাকা!
আরও পড়ুন-সিটিসেল ফিরে এলে বাংলাদেশের টেলিকম দুনিয়ায় কী পরিবর্তন আসতে পারে?
BTRC বারবার নোটিশ পাঠানোর পরও তারা পুরো অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়।
এর ফলেই সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের লাইসেন্স স্থগিত করে দেয়।
বাজার প্রতিযোগিতায় হার মানা
যখন গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক কোটি কোটি টাকায় বিজ্ঞাপন, নতুন অফার ও 4G নেটওয়ার্ক নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল —
সিটিসেল তখনও সীমিত কভারেজ ও দুর্বল মার্কেটিংয়ে আটকে ছিল।
গ্রাহকরা ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করেন।
এক সময় তাদের সক্রিয় গ্রাহক সংখ্যা ১৫ লাখ থেকে নেমে আসে মাত্র কয়েক হাজারে।
ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা সংকট
সিটিসেল পরিচালিত হতো Pacific Motors ও SingTel এর যৌথ বিনিয়োগে।
কিন্তু SingTel (সিঙ্গাপুর টেলিকম) ২০১২ সালে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দেয়।
এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনাগত অস্থিরতায় পড়ে, যা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত: BTRC-এর লাইসেন্স বাতিল
২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর, BTRC আনুষ্ঠানিকভাবে সিটিসেলের স্পেকট্রাম এবং লাইসেন্স বাতিল করে দেয়।
এদিন থেকেই সিটিসেলের নেটওয়ার্ক স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর গ্রাহকরা আর তাদের সেবা ব্যবহার করতে পারেননি।
BTRC জানায় —
“Repeated payment failure and regulatory non-compliance forced us to revoke Citycell’s license.”
এটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল অপারেটরের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি।
সিটিসেল বন্ধের পর কী হলো?
সিটিসেলের অবকাঠামো (টাওয়ার, ব্যাকবোন নেটওয়ার্ক ইত্যাদি) কিছু অংশ পরে বিক্রি বা লিজে দেওয়া হয়।
কর্মীরা অন্য টেলিকম কোম্পানিতে যোগ দেন,
আর গ্রাহকরা চলে যান গ্রামীণফোন, রবি বা বাংলালিংকে।
আজও অনেক পুরনো ব্যবহারকারী নস্টালজিয়া ভরে বলেন —
“সিটিসেলের ভয়েস কোয়ালিটি এখনো কেউ হারাতে পারেনি!”
ভবিষ্যতে কি সিটিসেল আবার ফিরে আসতে পারে?
এই প্রশ্নটি অনেকের মনে জাগে।
প্রযুক্তিগতভাবে, এটা অসম্ভব নয় — কিন্তু বাস্তবে খুব কঠিন।
ফিরে আসতে হলে সিটিসেলকে করতে হবে —
✅ BTRC থেকে নতুন লাইসেন্স সংগ্রহ
✅ সম্পূর্ণ নতুন GSM বা 5G প্রযুক্তিতে রূপান্তর
✅ বড় বিনিয়োগ ও ব্র্যান্ড রিবিল্ড
এখন পর্যন্ত এমন কোনো অফিসিয়াল ঘোষণা পাওয়া যায়নি যে তারা ফিরে আসছে।
তবে মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় “সিটিসেল ফিরে আসছে ২০ পয়সা মিনিটে” — এমন গুজব ছড়ায়, যা আসলে সত্য নয়।
উপসংহার
সিটিসেল একসময় ছিল বাংলাদেশের যোগাযোগ বিপ্লবের প্রতীক।
তাদের হাত ধরেই আমরা প্রথমবারের মতো মোবাইল ফোনে কথা বলেছিলাম।
কিন্তু সময়ের পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত পিছিয়ে পড়া, এবং আর্থিক দুরবস্থার কারণে এই কিংবদন্তি কোম্পানির অবসান ঘটে।
আরও পড়ুন-সিটিসেল সিম কি বাংলাদেশে আবার ফিরছে?
ℹ️ আরও কন্টেন্ট নিয়মিত পেতে- ফেসবুক পেজে যুক্ত থাকুন!
ℹ️ ভিডিও আকারে কনটেন্ট নিয়মিত পেতে –ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন!
আরও পড়ুন- BTCL সিমের দাম কত, কোথায় পাওয়া যাবে ও সুবিধা কী কী
👉টেক নিউজের সকল খবর সবার আগে পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন!
👉🙏লেখার মধ্যে ভাষা জনিত কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে অবশ্যই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
✅আজ এ পর্যন্তই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন 🤔


